ঢাকা, সোমবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দুই হাত ও এক পা ছাড়াই জীবন যুদ্ধে আশেক আলী

মোমেনুর রশিদ সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২
দুই হাত ও এক পা ছাড়াই জীবন যুদ্ধে আশেক আলী

গাইবান্ধা থেকে: আশেক আলী (৪০)। জীবন যুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা এমন এক বীর যার একটি হাতও নেই।

কেউ মুখে তুলে না দিলে একমুঠো খাবার দূরে থাক এক ঢোক পানিও জোটে না। শুধু তাই নয় তার পা একটি। তাতে ভর করেই লাফিয়ে পথ চলেন তিনি।

একসময় আর দশজনের মতো স্বাভাবিক ছিল আশেকের হাত-পা। ছিল সুখের সংসার। চাকরি জীবনে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এক দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে গেলেও দুটি হাত ও একটি পা হারান তিনি।

জীবনের এই করুণ মুহুর্তে অসহায় মানুষটি বুকভরা আশা-বিশ্বাস নিয়ে যাকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন, সেই প্রিয়তমা স্ত্রী চলে গেছেন অন্যের হাত ধরে। সেই সঙ্গে বিশ্বাস ভেঙে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে ফেলে গেছেন তাকে। তবু তিনি হার মানেননি। সব প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে মাথা উচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছেন।  

আশেক আলীর সেই স্বপ্ন পূরণে পথ দেখিয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং ‘নগদ’। পঙ্গুত্ব ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। সময়ের ব্যবধানে তিনি এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। সেই সঙ্গে তার এ প্রচেষ্টা এলাকার হাজারো বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।

জীবন যুদ্ধে হার না মানা দৃঢ়চেতা এই মানুষটির বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপাকুর উপজেলার বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নের হেলেঞ্চা গ্রামে। স্থানীয় শাল্টিরহাট বাজারে ‘আলিফ টেলিকম’ নামে একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তিনি।

শনিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় জীবনের নানা কঠিন প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে সামনে এগিয়ে চলা এ মানুষটির সঙ্গে। তিনি বলেন, ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা এলাহী মন্ডল বেঁচে নেই। ২০০০ সালে মিঠাপুকুর ডিগ্রী কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন আশেক। এরপর ২০০২ সালে ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এ লাইনম্যান হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৪ সালে পাশের ভেন্ডাবাড়ী এলাকার নাসরিন আক্তারের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে জান্নাতুল মাওয়া নামে এক মেয়ে জন্ম নেয়। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। একটি সুখী পরিবার ছিলেন তারা। এরপর এক ঝড়ে সব সুখ কেঁড়ে নেয়।

সেদিনের দূর্বিষহ স্মৃতিচারণ করে আশেক বলেন, দিনটি ছিল ২০০৯ সালের ৬ই অক্টোবর। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে ১১ হাজার কেভি হাইভোল্টেজ লাইন রিপিয়ার কাজে পোল-খুঁটিতে উঠেন আশেক। সে সময় অনাকাঙ্খিত একটি দুর্ঘটনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তার দুটি হাত ও একটি পা সম্পূর্ণ ঝলসে যায়। তিনি প্রায় পৌনে একঘণ্টা বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ঝুলে ছিলেন। তখন তার সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল। সে সময়টা মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন আশেক।  

এরপর তার একাধিক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস চিকিৎসা চলে। তার শরীরে ৯ বার সার্জারি করা হয়। অবশেষে দুটি হাত বগলের নিচ থেকে এবং একটি পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। তিন হাত-পা রেখে একটি পায়ে ভর করে ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি আশেক ফেরেন শ্বশুরবাড়ি ভেন্ডাবাড়ীতে। সেখানে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। এসময় তার কেনা ১০ শতাংশ জমিতে সঞ্চিত-সহায়তার সর্বস্ব পুঁজি দিয়ে বাড়ি করেন। একটা সময় জমিসহ সেই বাড়ি স্ত্রীর নামে লিখে দেন একটু আশ্রয়-ভালবাসার আশায়। সেখানেও তিনি চরম ভাবে প্রতারিত হন। সেই স্ত্রী এখন অন্যের ঘরণী।  

তার সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শোনাতে গিয়ে আশেক বলেন, এত কিছুর পরেও তিনি ভেঙে না পড়ে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছেন। মনে বেঁচে থাকার শক্তি-স্বপ্ন যুগিয়েছেন। সেলক্ষ্যে বিদ্যুত বিভাগে চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় বাজারে একটি ইলেকট্রিক মালামালের দোকান শুরু করেন। এরই মধ্যে বিছানায় শুয়ে পা দিয়ে মোবাইল চালাতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন আশেক। তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন মোবাইল দিয়ে টাকা লোড দেওয়ার পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসার। আর তার এই যাত্রায় অবিচল বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়ায় এমএফএস প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’। তাকে দেওয়া হয় ‘নগদ’ উদ্যোক্তার কাগজপত্র। আর এখান থেকেই বদলে যেতে শুরু করল আশেকের সময়।  

তিনি বলেন, দেশে যে কয়টি মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি আছে এর মধ্যে ‘নগদে’ খরচ সবচেয়ে কম। ফলে সাধারণ মানুষে এতে আগ্রহ বেশী। পাশাপাশি ‘নগদে’ ডাক বিভাগের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এতে মানুষে আস্থা অবিচল। আর এসব প্রত্যক্ষ করেই আমি আমার ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে ‘নগদ’ বেঁছে নিয়েছি। নগদে নানাবিধ সুবিধার জন্য তার অনেক কাস্টমার। এলাকার সবাই ভাতা তুলতে তার দোকানে আসেন। এভাবেই আস্তে আস্তে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকে সাবলম্বী হয়ে ওঠেন আশেক। হাত-পা ছাড়াই যুদ্ধ করে চলেছেন সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে।  

আশেকের দোকানে আসা-যাওয়াসহ নানা কাজে সহায়তা করেন মেঝ ভাইয়ের ছেলে ভাতিজা খাইরুল। দোকানে টাকা দেওয়া-নেওয়াসহ সব কাজ আশেক আলী নিজেই করেন। এছাড়া খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক কাজে সহায়তা করেন আশেকের মেজো ভাবী।

আশেক আরও জানান, তার একমাত্র মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া জয়পুরহাট ক্যাডেট কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। সুযোগ পেলেই সে বাবাকে দেখতে আসে। দোকান থেকে অর্জিত আয়ের পাশপাশি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে প্রতি মাসে যে বেতন পান তা দিয়ে সন্তানের পড়াশুনাসহ সাংসারিক অন্যান্য চাহিদা মিটে যায়।  

‘সবমিলিয়ে আল্লাহর রহমতে এখন বেশ ভালো আছি। ’ বলেন আশেক আলী।  

এলাকার তথা-দেশের বেকার যুবকদের উদ্যেশ্যে তিনি বলেন, দুই হাত, এক হারানো তার মতো একজন পঙ্গু মানুষ যদি একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে ভালভাবে খেয়ে পড়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে। তবে, সুস্থ্-সবল এসব যুবকদের বেকার থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২
এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ