ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

১৫ আগস্টের শিশু শহীদ সুকান্ত আব্দুল্লাহ সেরনিয়াবাত 

ড. জেবউননেছা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২২
১৫ আগস্টের শিশু শহীদ সুকান্ত আব্দুল্লাহ সেরনিয়াবাত 

১৯৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ। চারিদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি।

স্বাধীনতা উন্মুখ মানুষের ভেতরে এক রকম উত্তেজনা, কখন একটি স্বাধীন দেশ হবে। যে দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ। সেই উন্মত্ততায় যুদ্ধে অন্তঃসত্তা স্ত্রী রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে রণাঙ্গনে গিয়েছেন এক মুক্তিযোদ্ধা। যিনি ছিলেন মুজিব বাহিনীর কমান্ডার। সেই সময় ১৯৭১ সালের ২২ জুন বরিশালের গৌরনদীর চাঁদশী গ্রামে জন্মগ্রহণ করে তাঁর সন্তান। জন্মের পর তাকে প্রথম কোলে নেন রওশন আরা নীলা, যিনি শিশু সন্তানটির ছোট খালা। আদর করে সবাই শিশুটির নাম রেখেছিল সুকান্ত বাবু। সুকান্তের পিতার নাম আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ (সাবেক চিফ হুইপ এবং বর্তমানে সংসদ সদস্য), মায়ের নাম শাহানারা আব্দুল্লাহ। দাদা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং দাদীর নাম আমেনা বেগম হেলেন। যিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেজো বোন।

ছোট খালার স্মৃতিচারণে সুকান্ত এখনো জীবন্ত। মা রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকতেন বিধায় সকালে নানাবাড়ি চলে আসত, বিকেলে ফিরে যেত। একবার ছুটির দিনে বাবা মা বাসায় থাকার কারণে সুকান্তকে নানাবাড়ী পাঠানো হয়নি। সে পালিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। এরপর তিন রাস্তার মোড়ে এসে নানাবাড়ী যাবার পথ হারিয়ে ফেলে। পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না করতে থাকলে এক রিকশাওয়ালা তাকে চিনে ফেলে। পরে তাকে নানাবাড়ী পৌঁছে দেয়। বড় খালাকে বলত সোনা মা। নানা রকম প্রশ্ন করত সুকান্ত। মাঝে মাঝে খালা বলতেন, তুমি এত প্রশ্ন করো কেন? একবার ঢাকা থেকে ফেরার পথে সুকান্তের মা একটি শাড়ী কিনেন। সুকান্ত নানাবাড়ী গিয়ে খালাকে বলেন, তোমার জন্য শাড়ী কিনেছি। তুমি এখনি পরো। খালাদের মুখের গান শুনে একটি গানের কলি খালাদের গাইতে বলত, ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব না/চুল ভিজাবনা আমি বেশী ভিজাব না। ’ খালারা হারমোনিয়াম বাজাতেন। তা দেখে সেও নিজে নিজে হারমোনিয়াম বাজানোর চেষ্টা করত। হারমোনিয়ামের সাথে সুকান্তের ছবিতে খালা স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়ান। ভাগ্নের কথা মনে করে কেঁদে বুক ভাসান। ভাগিনা হারিয়ে গিয়েছে একথা শোনার পর দুই খালা মুখে ভাত তোলেননি তিন দিন।  

তার মেজো খালা হোসনে আরার স্মৃতিচারণে দেখা যায়, সুকান্ত ভীষণ শান্ত-সুবোধ এবং ফুটফুটে ছিল। ভীষণ বুদ্ধিমান ছিল। বয়সের তুলনায় স্বাস্থ্যবান ছিল। লম্বা অনেক বেশী ছিল। মাঝে মাঝে যখন চোর পুলিশ খেলত, তখন বলত, আমি এমন করে পালিয়ে যাব, তোমরা আমাকে আর খুঁজে পাবে না। বড় খালাকে ডাকত বড় সোনা মা এবং ছোট খালাকে বলতো ছোট সোনা মা। সুকান্তের নানাবাড়ীর সকলে তাকে প্রাণভরে ভালোবাসতেন। এখনো খালা তার স্মৃতি মনে করে কাঁদেন।  

তাদের বাড়ীর কাজের সহকারী জলিল তাকে নিয়ে যখন ঘুরতো তখন সে বলতো, জলিল কাকা  আমি ঐ আকাশের তারা হয়ে যাব। সুকান্ত বাবু যখন বরিশালের কালিবাড়ীতে বাস করত তখন বাড়ীর দোতলার বারান্দায় বাবুর নিরাপত্তার কথা ভেবে গ্রিল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল। বড়শি দিয়ে অন্যসব ছেলেদের মাছ ধরা দেখে বাবু ও মাছ তাদের বাড়ির পুকুরে মাছ ধরতে চাইতো। এ কারণে বাড়ির সামনে একটি পাকা হাউস তৈরি করে বিভিন্ন জাতের মাছ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সুকান্ত ছিল মা ভক্ত। সবার আদরের ছিল সুকান্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র চার বছর বয়সে তার জীবন প্রদীপ নিভে যায় ঘাতকের বুলেটে।

তার মায়ের স্মৃতিচারণে দেখা যায়, বিপথগামী সেনাদস্যুরা যখন গুলি চালাচ্ছিল, তখন তার বড় ছেলে সুকান্ত কোলে উঠতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন তার কোলে ছিল তার ছোট ছেলে দেড় বছরের শিশু সাদিক আব্দুল্লাহ। সুকান্তের আকুতিতে তাকে কোলে তুলে নেয় শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত। শহীদ সেরনিয়াবাতকে সুকান্তের বাবা মনে করে সেনা সদস্যরা তার পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে ব্রাশফায়ার করে। তিনি মুহূর্তের মধ্যে সুকান্তকে নিয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুকান্তের মায়ের শরীরে পেছন দিকে তিনটি গুলি লাগে। এরপর তিনি সোফার ওপর ছিটকে পড়েন। তবু তিনি কোল থেকে তার সন্তান সাদিককে ছাড়েননি। পুলিশ আসার পর বাবুকে শহীদ ভাইয়ের বুকের নিচ থেকে ওঠানো হলো। দেখলেন সুকান্তের নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার আফসোস, সুকান্ত তার কোলে উঠতে চেয়েছিল, কিন্তু সে কোলে নিতে পারেনি। একসাথে নয়জন গুলিবিদ্ধ হয়। এই নয়জনকে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আনোয়ার হোসেন আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেন। এক সময় তিনি জানতে পারেন তাঁর স্বামী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আছেন। তিনি ভারত যাবার আগে সাদিক এবং মেয়ে কান্তাকে বরিশালে তার গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গাড়ির শব্দ পেলেই সাদিক ও কান্তাকে লুকিয়ে রাখতেন। কারণ তারা ভয় পেতেন। এছাড়া তার বাবাকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতেছিল। পুলিশ দুইবার তল্লাশি চালায়। দ্বিতীয়বারের তল্লাশির সময় সুকান্তের নানাকে ধরে নেয়া হয়। সুস্থ হলে গ্রামে যান। আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে নানাভাবে না পেয়ে শ্বশুর কাজী মোখলেছুর রহমানকে জেল খাটতে হয় আড়াই বছর। তার কাছ থেকে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর তথ্য খোঁজেন। রোগে শোকে বুলেটের ক্ষত নিয়ে এগিয়ে যায় জীবন। অতঃপর শাহানারা আব্দুল্লাহ ২০২০ সালের ৭ জুন মারা যান।  

সুকান্ত শব্দের অর্থ ভাগ্যবান। কিন্তু নামের অর্থের সাথে তার জীবনটি মিলেনি। বেঁচে থাকলে হয়তো হতে পারত ভাগ্যবান। সবার জীবনের সব কিছু মিলে না। সুকান্ত এখন দূর আকাশের তারা হয়ে বনানী গোরস্তানে শুয়ে আছেন। কিন্তু একটি ছোট বাক্সে সুকান্তের মোজা, গেঞ্জি এবং ছোট একটি লুঙ্গিতে সুকান্তের স্মৃতি আকঁড়ে আছেন সুকান্তের দুই খালা। সুকান্তের দাদী বলতেন, সুকান্ত অল্প বয়সে মারা গিয়েছে। কেউ ওকে সুকান্ত বলে ডাকবিনা। এজন্য সুকান্তের দাদী সুকান্তকে বাবু বলে ডাকতেন। দাদীর কথাই মিলে গিয়েছে। সুকান্ত অল্প বয়সেই হারিয়ে গিয়ে মিশে গেছে নিঃসীম দূর নীলিমায়। ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘সিড়িঁ’ কবিতার কয়েকটি চরণ দিয়ে শেষ করব ছোট্ট শিশু শহীদ সুকান্ত সেরনিয়াবাতের জীবন কাহিনী- ‘আমরা সিঁড়ি তোমরা আমাদের মাড়িয়ে/প্রতিদিন অনেক উচুঁতে উঠে যাও/তারপর ফিরে তাকাও না পিছনের দিকে;/তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক/পদাঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন’। আজ এই দিনে সুকান্ত আব্দুল্লাহ সেরনিয়াবাতকে স্মরণ করছি।  

তথ্যসূত্র
১.    আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা, হুরুন্নেছা, হেনা সেরনিয়াবাত এবং হামিদা সেরনিয়াবাতের সাক্ষাৎকার।
২.    আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকনের সাক্ষাৎকার।
৩.    ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট সেরনিয়াতের বাড়ীতে আহত খ.ম জিল্লুর রহমানের সাক্ষাৎকার।
৪.    ‘আমাদের বাড়ীতে যেভাবে হত্যাকান্ড চালানো হলো’ হামিদা সেরনিয়াবাত, দৈনিক ভোরের কাগজ ১৫, ১৬, ১৮ আগষ্ট, ১৯৯৪ইং
৫.    সুকান্ত সেরনিয়াবাতের খালা এবং মামার সাক্ষাৎকার।


লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।