ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

তুরাগে বিস্ফোরণ, অনিশ্চয়তায় নিহতদের পরিবার 

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০২২
তুরাগে বিস্ফোরণ, অনিশ্চয়তায় নিহতদের পরিবার  ফাইল ছবি

ঢাকা: মাত্র পাঁচ মাস আগে ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছেন মো. শাহীন মিয়া (২৫)। তার স্ত্রী প্রতিবন্ধী,  ডান হাত অচল।

শাহীন আগে ঢাকার একটি কারখানায় স্বল্প বেতনে লেবার/হেলপার হিসেবে কাজ করতেন। সংসারের সচ্ছলতা বাড়াতে কারখানার চাকরি ছেড়ে গত একমাস হলো অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু ফুটফুটে শিশু সন্তানের মুখে বাবা ডাক আর শোনা হলো না শাহীনের। প্রতিবন্ধী সহধর্মীনী ও সন্তাকে ছেড়ে শাহীন চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

রাজধানীর তুরাগ থানাধীন কামারপাড়া রাজাবাড়ি পুকুরপার এলাকায় গাজী মাজহারুল ইসলামের গ্যারেজের একটি অটোরিকশা চালাতেন তিনি। গত ৬ আগস্ট ভোরে গ্যারেজ মালিক গাজী মাজহারুলের ফোন পেয়ে ভাঙারির দোকানে কাজ করতে যেতে হয় শাহীনকে। দুপুর ১২টার দিকে দাহ্য স্প্রে ও ফোমের বোতল বিষ্ফোরণের আগুনে ঝলসে যায় শাহীনসহ আরও সাত জনের শরীর। আগুনে শাহীনের শরীরের ৩৫ শতাংশ অংশ দগ্ধ হয়। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিও) লাইফ সার্পোটে ছিলেন তিনি। এক সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে হার মানতে হলো অটোরিকশা চালক শাহীন মিয়াকে। এর আগে একে একে দগ্ধ অন্য ৭ জনেরও মৃত্যু হয়।  

হাসপাতালের চিকিৎসক ও পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত শাহীনের অবস্থা একইরকম ছিলো। তবে শুক্রবার (১২ আগস্ট) বেলা ১১টা থেকে তার অবস্থার অবনতি হয়। শাহীনের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিলো। সেজন্য চিকিৎসক তাকে লাইফ সাপোর্টে রেখেছিলেন। কিন্তু শুক্রবার রাত ১০টার দিকে হাসপাতালের আইসিইউর বেডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় শাহীন মিয়ার। শাহীনের স্ত্রী-সন্তান ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রাজনগর বিত্তিদেবী গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তাদের সঙ্গে শাহীনের বৃদ্ধ মা থাকেন।

দগ্ধ অটোরিকশা চালক শাহীন মিয়ার বড় ভাই মো. ফিরোজ বাংলানিউজকে বলেন, এক আগুনে আমার ছোট ভাইকে কেড়ে নিলো। তুরাগে এসে শাহীন অটোরিকশা চালাতো। এর পাশাপাশি গ্যারেজ মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী তার ভাঙারির দোকানেও কাজ করতো। ঘটনার দিন ভোর ৬ টার দিকে গ্যারেজ মালিক গাজী মাজহারুল শাহীনকে ফোন করে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যান, সেখাগে ভাঙারি মালামালের কাজ করছিলো।  

গত ৬ আগস্ট তুরাগ ধানাধীন রাজাবাড়ি পুকুরপাড় এলাকার রিকশাগ্যারেজ সংলগ্ন ওই ভাঙারির দোকানে বিষ্ফোরণ থেকে লাগা আগুনে দগ্ধ হন ৮ জন।  

ঘটনার দিন রাতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিকশার গ্যারেজ ও ভাঙারির দোকান মালিক গাজী মাজহারুল ইসলাম (৪৭), তার ভাগিনা আলমগীর হোসেন আলম (২৩) ও অটোরিকশা চালক নূর হোসেনের (৬০) মৃত্যু হয়। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় অটোরিকশাচালক মো. মিজান (৩৫), শফিকুল ইসলাম (২৫), আল আমিন (৩৫) ও মাসুমের (৩৮)।  

আগুনে নুর হোসেনের ৯৫ শতাংশ, শফিকুল ইসলাম ৮০ শতাংশ, আল আমিনের শরীরের ৭৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিলো। এই ঘটনায় তুরাগ থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলায় দায়ের করেছে।  

অন্ধকারাচ্ছন্ন নিহত সাত জনের পরিবার
গাজী মাজহারুল ইসলাম (৪৭) রাজধানীর তুরাগ থানাধীন রাজাবাড়ি পুকুরপাড় এলাকায় ভাঙারি দোকান ও রিকশা গ্যারেজের মালিক। বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ এ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। গাজী মাজহারুল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তার মৃত্যুতে পরিবারের সদস্যরা এখন দিশেহারা।

নিহত মাজহারুলের স্ত্রী রোকসানা আক্তার বলেন, পরিবারে তাদের তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে তামান্না আক্তার ও যূথি আক্তারের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে বীথি আক্তার এবার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। ভালো ফল করায় বাবার ইচ্ছে ছিল বীথিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। বীথিরও অনেক ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার স্বপ্নটাও শেষ হয়ে গেল।

অটোরিকশা মেকানিক আলমগীর হোসেন আলম (২৩) ছিলেন গাজী মাজহারুলের ভাগিনা। আপন না হলেও আলম ছোটবেলা থেকেই মাজহারুলের কাছে মানুষ হয়েছেন। ভাঙারির দোকানে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনিও দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ ঘটনায় আলমের শরীরের অধিকাংশই পুড়ে যায়। তার গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি থানার বিলবালিয়া এলাকায়। হাতপাতাল থেকে আলমের মরদেহ শনাক্ত করেন তার চাচা রবিউল ইসলাম।

গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার রাঘবপুর গ্রামে অটোরিকশাচালক নূর হোসেনের (৬০) বাড়ি। তুরাগের রাজাবাড়ি এলাকায় বিষ্ফোরণে দগ্ধ হয়ে নুর হোসেনের মৃত্যু হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। তুরাগের কামারপাড়া এলাকায় পরিবারসহ বসবাস করতেন তিনি।

নুর হোসেনের ছেলে নাজমুল হোসেন বলেন, ঘটনার দিন সকালে রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে কামারপাড়া রাজাবাড়ি পুকরপাড় গ্যারেজে গিয়েছিলেন বাবা। দুপুরে খবর পাই গ্যারেজে কী একটা বিস্ফোরণ হয়েছে। অনেকেই দগ্ধ হয়েছেন। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাবার মৃত্যু হয়।

নীলফামারী জেলার জলঢাকা থানার মজিবর রহমানের ছেলে শফিকুল ইসলাম। তুরাগের কামারপাড়া এলাকায় থাকতেন তিনি। গ্যারেজে তিনি রিকশা মেরামতের কাজ করতে। পাশাপাশি মাজহারুলের ভাঙারির দোকানেও কাজ করতেন। গত মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) রাত সাড়ে ৮টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন তার মৃত্যু হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০২২
এসজেএ/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।