ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

অযত্নে বেড়ে ওঠা হোগলা গাছের গুঁড়া থেকে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু খাবার

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২২
অযত্নে বেড়ে ওঠা হোগলা গাছের গুঁড়া থেকে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু খাবার

লক্ষ্মীপুর: নদীর পরিত্যক্ত চর বা খাল-বিলের পাশে অযত্নে অবহেলায় জন্মাচ্ছে হোগলা গাছ। আর বর্ষা মৌসুমে সেই গাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে হোগলা গুঁড়া।

স্থানীয়ভাবে যা 'ওগলের গুঁড়া' নামে পরিচিত।  

এছাড়া শুকনো হোগলা পাতা প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হচ্ছে দড়ি। যা স্থানীয় কৃষকদের স্বাবলম্বী করে তুলছে।  

লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর জেগে ওঠা পরিত্যক্ত চর, চরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল এবং উপকূলীয় এলাকার অনাবাদি জমি ও খাল-বিলে দেখা মিলে হোগলা গাছের।  

উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা জানায়, জেলার মেঘনা নদীর বিভিন্নস্থানে জেগে ওঠা চরে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাচ্ছে হোগলা গাছ। অল্প সময়ের মধ্যেই ওইসব গাছ এলাকা ভরে যায়। চরে বসবাসকারীরা প্রতি বছরের আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাসে হোগলা গাছ থেকে ফুল কেটে নেয়, সেই ফুল থেকে গুঁড়া সংগ্রহ করে। সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে তারা।  

তারা জানায়, শুধু মেঘনার চরাঞ্চলেই নয়- নদী সংলগ্ন জেলা সদরের চর রমনী মোহন, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার বিভিন্ন খাল-বিলের পাড়েও জন্মে এই হোগলা গাছ।  

স্থানীয়রা জানায়, এক সময় হোগলা গাছকে আগাছা হিসেবে দেখা হতো। পতিত জমিকে আবাদী জমিতে রূপান্তর করার জন্য এই আগাছাগুলো কেটে পুড়িয়ে ফেরা হতো। কেউ কেউ এগুলোকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতো, আবার কেউ বিছানা তৈরির কাজে ব্যবহার করতো। তবে প্লাস্টিকের যুগে এখন আর হোগলা পাতার বিছানার চাহিদা নেই।  

এক সময়ের আগাছা এখন অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। হোগলা গাছের পাতা কেটে সেগুলো রোদে শুকিয়ে বিক্রি করা হয়, যা থেকে তৈরি হয় দড়ি। শুকনো পাতার চাহিদা রয়েছে লক্ষ্মীপুরের পার্শ্ববর্তী জেলার নোয়াখালীর আন্ডারচর এলাকায়।  

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মেঘনার তীরবর্তী চররমনী মোহন এলাকার কৃষক আবদুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, আগে চরের মধ্যে হোগলা পাতা পড়ে থাকতো। জ্বালানি হিসেবে কেটে আনতাম। কিন্তু এখন আর চাইলেই কাটা যায় না। কারণ এগুলো এখন বেচা-বিক্রি হয়।  

তিনি বলেন, মেঘনার চরে থাকা প্রায় ২ একর জমি এক বছরের জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়ে ভাড়া নিয়েছি। ওই জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই হোগলা গাছ জন্মে। বছরে দুই বার হোগলা পাতা কেটে আনি। এই জমি থেকে কেটে আনা হোগলা পাতা লাখ টাকায় বিক্রি করতো পারবো বলে আশা করি।  

আরেক কৃষক শাহাবুদ্দিন বলেন, চরের জমিতে হোগলা গাছ এমনিতেই জন্মে। কোনো পরিচর্যা করতে হয় না। জৈষ্ঠ্য মাসের দিকে গাছের গোড়া পর্যন্ত পাতা একবার কেটেছি। আপনা-আপনিই সেই গোড়া থেকে আবার গাছ জন্মাবে। ছয় মাস পর আবার কাটতে পারবো।  

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মতিরহাটের হোগলা ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি আঁটি শুকনো হোগলা পাতা কৃষকদের কাছ থেকে দুইশ থেকে দুইশ ২০ টাকা দরে কিনি। সেগুলো নোয়াখালীর আন্ডারচর থেকে ব্যাপারীরা এসে আমাদের কাছ থেকে ট্রাক ভরে কিনে নিয়ে যায়। সেখানে শুকনো পাতা প্রক্রিয়াজাত করে দড়ি তৈরি করা হয়। দড়ি দিয়ে আবার সুদৃশ্য আসবাবপত্র তৈরি করা হয়।  
 
প্রতি হাটবারে লক্ষ্মীপুর শহরের হোগলার গুড়া বিক্রি করেন হযরত আলী। তিনি প্রতিকেজি হোগলার গুঁড়া ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি করেন। স্থানীয়রা এ গুঁড়া নিয়ে পিঠা কিংবা তেলে ভাজি করে খায়। মুখরোচক এ খাবার অনেকের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।  

হযরত আলী বাংলানিউজকে বলেন, নদীর জেগে ওঠা চরে জন্মানো হোগলা গাছ থেকে স্থানীয়রা গুঁড়া সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুরের পশ্চিম অংশে থাকা মেঘনা নদীর চর এবং ভোলার বিভিন্ন চর থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়। রায়পুর উপজেলার মোল্লার হাট ও হায়দারগঞ্জ বাজারে প্রতিদিন চরের বিভিন্ন অংশ থেকে সংগ্রহকারীরা বস্তা ভরে বাজারে এনে পাইকারি হিসেবে বিক্রি করে। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে কেজিদরে বিক্রি করে।  

সদর উপজেলার চররমনী মোহনের চর আলী হাসান গ্রামের কৃষক নুরে আলম বলেন, আমার বাড়ির পাশে যে খাল রয়েছে, তার দুইপাশে প্রচুর হোগলা গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছে। বর্ষা মৌসুমে ওই গাছে ফুল আসে। সেগুলো আমি কেটে আনি। পরে ফুল থেকে হোগলের গুঁড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করি। এতে প্রতি বর্ষা মৌসুমে আমার বাড়তি লাভ হচ্ছে।  

হোগলা গুড়া রান্নার নিয়ম: ৫০০ গ্ৰাম হোগলা গুঁড়ার সঙ্গে নারিকেল তিন কাপ ও চিনি দুই কাপ (মিষ্টি কম বেশি খাওয়ার ওপর নির্ভরশীল), পানি এক কাপ একসঙ্গে মিশিয়ে চুলোর হালকা তাপে রেখে দিলে কিছুক্ষণ পর তৈরি হয়ে যাবে সুস্বাদু হোগলা গুড়া রান্না।  

রায়পুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন বলেন, হোগলা পাতার ফুল থেকে সংগ্রহ হয় হোগলার গুঁড়ি। এটি চকচকে হলুদ রঙের হয়। এ গুঁড়োটি খুব পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাবার। হোগলার গুঁড়া দিয়ে এখানে জনপ্রিয় একটি কেক তৈরি হয়। রায়পুর উপজেলার চরবংশী, খাসের হাট, ঘাসিয়ার চর, চরপাতা, সদর উপজেলার পশ্চিম চর রমনীমোহন ও দক্ষিণ চর রমনীমোহনে হোগলা পাতা বেশি উৎপাদিত হচ্ছে।

কমলনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আতিক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, নদী কেন্দ্রীক যেসব জমিতে পানি জমে থাকে, ওইসব জমিতে প্রাকৃতিকভাবে হোগলা গাছ জন্মে। জমির মালিকরা সেগুলো কেটে বিক্রি করেন। হোগলা এখনো কৃষিপণ্যের আওতায় আসেনি। ব্যাপকভাবে হোগলা পাতার চাহিদা তৈরি হলে তখন হয়তো বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯০6 ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad