ঢাকা, সোমবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ মে ২০২৪, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

ঝুঁকি নিয়ে বানভাসিদের পাশে স্বেচ্ছাসেবীরা 

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৪ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২২
ঝুঁকি নিয়ে বানভাসিদের পাশে স্বেচ্ছাসেবীরা 

ঢাকা: মানুষগুলোর কেউই শ্রমিক নয়, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিংবা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। এ মানুষগুলোই কুলি-মজুরের মতো কাজ করছে।

মাথায় বহন করছে ভারী বস্তা। বুক পানি মাড়িয়ে অসহায় মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে খাবার। বলছি সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যায় আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো স্বেচ্ছাসেবকদের কথা।  

বন্যায় মানবিক বিপর্যয় ঘটছে দেশের সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। বিদ্যুৎ নেই, খাবার পানি নেই, গ্যাস নেই, চলাচলের রাস্তাগুলো বুক পানিতে তলিয়ে গেছে। চারিদিকে বানের জলে আটকা পড়া মানুষের হাহাকার। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন দুই জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারী বৃষ্টিতে নদ-নদী ও হাওরের পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় বন্যার আরও বিস্তৃতি ঘটেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। সিলেটে থাকা নিরাপদ নয়। এমন অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বানভাসি অসহায় মানুষগুলোকে সহায়তা ও উদ্ধারে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা।  

শুধু স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক নয় অন্য অঞ্চল থেকে গিয়েও স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন। অচেনা পথ চেনা নেই জানা নেই তবুও ছুটে চলেছে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এসব স্বেচ্ছাসেবীরা।  ইতোমধ্যে বানভাসিদের জন্য কাজ করতে গিয়ে সিলেটে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে টিটু চৌধুরী নামে এক স্বেচ্ছাসেবকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি সামাজিক সংগঠন টিম ৭১-এর সদস্য ছিলেন বলে জানা যায়। শনিবার দুপুরে সিলেট নগরের শাপলাবাগে নিজ বাসার সামনে পানির নিচে ছিড়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনি মারা যান। এমন খবরেও স্বেচ্ছাসেবকরা পিছ পা হচ্ছেন না। বিভিন্ন জেলা থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা ছুটে যাচ্ছেন সিলেটের দিকে। অর্থ জোগাড় করে তা দিয়ে পণ্য কিনে তা পৌঁছে দিচ্ছে অসহায় মানুষগুলোর কাছে।  

এ প্রসঙ্গে কথা হয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা সালমান খান ইয়াসিনের সঙ্গে।  

তিনি জানান, ইতোমধ্যে সিলেট-সুনামগঞ্জ এলাকায় তাদের ২০ জনের একটি টিম কাজ করছে। বন্যায় অসহায় মানুষগুলোকে তারা শুকনো এবং রান্না করা খাবার বিতরণ করছে। রোববার (১৯ জুন) এক হাজার মানুষকে রান্না করা খাবার দেওয়া হয়েছে। সোমবার থেকে তা তিন হাজার করা হবে।  

সালমান খান ইয়াসিন বলেন, আমরা আপাতত মানুষকে খাবার বিতরণ করছি। বন্যার পানি শুকিয়ে গেলে পুনর্বাসন কাজে নামবো। যাদের ঘর-বাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে তাদের ঘরবাড়ি মেরামত করে দেওয়া হবে। অসহায় গরিব যাদের গবাদিপশু মারা গেছে তাদের গবাদি পশু কিনে দেব।  

তিনি আরও বলেন, সিলেট ছাড়াও নেত্রকোনা ও কুড়িগ্রামেও তাদের স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছেন। সমাজের নানা-শ্রেণি পেশার মানুষ অর্থ সহায়তা পাঠাচ্ছে তা দিয়েই অসহায় মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে।  

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মাস্তুল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কাজী রিয়াজ রহমান আসিফ বলেন, সিলেটে পানিবন্দী মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি ও স্রোত ভেঙে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছেন শিশু ও বয়স্করা। আটকে পড়াদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। যেখানেই শুকনো ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে আমরা সিলেটে কাজ করছি। মাস্তুলের ১৮ জনের টিম সিলেট ও সুনামগঞ্জ রুটে এবং কোম্পানীগঞ্জ এলাকায় কাজ করছে। এর মধ্যে একটি টিম বন্যার্তদের খাবার বিতরণ করছে। অন্য টিম নৌকা এবং অ্যাম্বুলেন্সে করে আটকে পড়া মানুষদের সহায়তা করছে।  

তিনি বলেন, মানবিক মানুষদের সাড়া মিলছে। অনেকেই দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য অর্থ পাঠাচ্ছেন।  

সিলেটের বিয়ানীবাজার মানবিক টিমের সংগঠক জুয়েল আহমেদ সাফি বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায় এসে কাজ করছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা অন্য এলাকার স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা করছে। স্থানীয় এবং অন্য এলাকার স্বেচ্ছাসেবকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে।  

ফেনী বাসীর মানবিক সহায়তা নিয়ে সিলেটে গিয়েছে জেলার স্বেচ্ছাসেবক আমের মক্কী।  

তিনি জানান, সিলেটে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে আমরা বসে থাকতে পারি না। ফেনী জেলার মানুষ সহায়তা করেছে সেই সহায়তা পৌঁছে দিতে এসেছি। এখানে সব চেয়ে কষ্টে আছে শিশুরা। আমরা শিশু খাদ্য বিতরণের ওপর জোর দিয়ে কাজ করবো।  

অপরদিকে সিলেটের সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের বাহারী যে তরীগুলোতে পর্যটকরা ঘুরে বেড়াতো, হাওরের রূপ দেখতো সেই তরীগুলো এখন বন্যা দুর্গত অসহায় মানুষগুলোর আশ্রয় ও ত্রাণ কর্তার ভূমিকা পালন করছে। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে তরী (হাউসবোট) মালিকরা। পর্যটকবাহী অভিজাত তরীগুলোর (হাউসবোট) মালিকরা নিজেদের ব্যবসা রেখে আশ্রয় দিচ্ছেন বন্যা দুর্গত অসহায় মানুষদের। উদ্ধার কাজেও রাখছেন ভূমিকা।  

শুধু একটি দুটি নয় সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটন ব্যবসায় জড়িত প্রায় সব হাউসবোট এখন এই কাজ করছে। পর্যটকদের খাবারের জন্য নৌকায় যে খাদ্যপণ্য কেনা ছিল সেগুলো রান্না করে খাওয়ানো হচ্ছে বন্যা দুর্গতদের। আটকে পড়াদের উদ্ধারেও কাজ করছেন তারা।

সিন্দাবাদ তরীর ইমরানুল আলম বলেন, কখন সরকারি সহায়তা আসবে, কখন এটার বণ্টন হবে সেটার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেরাই একেকজন সাহসী যোদ্ধার বেশে নেমে পড়েছেন।

সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করা স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় প্রায় এক হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবক বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে বানভাসি মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াচ্ছে এসব স্বেচ্ছাসেবীরা।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৪ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২২
এসএইচডি/আরআইএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।