ঢাকা, সোমবার, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ মে ২০২৪, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বাবার হাত ধরে লাশ কাটা পেশায় ৩ ভাই

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৫ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২২
বাবার হাত ধরে লাশ কাটা পেশায় ৩ ভাই

ঢাকা: আলী, মোবারক ও চন্দন ছদ্মনামের এ তিন ব্যক্তি পরস্পর ভাই। তাদের বাবার নাম শংকর।

১৮ থেকে ২০ বছর আগে তার মৃত্যু হয়। পেশা ছিল লাশ কাটা। ময়নাতদন্তের জন্য আসা লাশ কাটতেন তিনি। তার হাত ধরেই আলী, মোবারক ও চন্দন আসেন লাশ কাটা পেশায়।

শংকরের মৃত্যুর পর ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন আলী ও মোবারক।  

ছোট থেকে বাবার লাশ কাটা দেখতে দেখতে বড় হওয়া তিন ভাইও এখন লাশ কাটেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী তারা। তিন ভাইয়ের মধ্যে আলীর চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষ। মোবারক ও চন্দন এখনও ঢামেকে লাশ কাটেন। থাকেন মর্গের পাশে কোয়ার্টারে।

জানা গেছে, শংকরের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে আলীর কাঁধে পড়ে লাশ কাটার দায়িত্ব। বছরের পর বছর ধরে ফরেনসিক চিকিৎসকদের উপস্থিতিতে পালা করে লাশ কেটে যাচ্ছেন তিন ভাই। তাদের ছোট আরেক ভাই আছেন। অবশ্য তিনি লাশ কাটার কাজ করেন না।

বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) দুপুরে ঢাকা মেডিকেল মর্গে গিয়ে কথা হয় আলীর সঙ্গে। জানা যায় নানা তথ্য। তিনি জানান, বাবা ছাড়াও তার দাদা ও দুই চাচা রবি ও মিন্টু লাশ কাটার কাজ করতেন। অনেকটা বংশ পরম্পরায় তারা এই পেশায় এসেছেন। দাদা-বাবা-চাচারা কেউ বেঁচে নেই।

আলী বলেন, ছোটবেলা থেকেই লাশ কাটার কাজ শিখেছি বাবার কাছ থেকে। আমরা এখন সরকারি চাকরি করি। আমরা মানুষের সেবায় নিয়োজিত। সমাজের লোকজন আমাদের ‘ডোম’  বলে ডাকে।

এই ‘ডোম’ শব্দ নিয়ে মহা আক্ষেপ রয়েছে আলীর মনে। তিনি বলেন, আমরা সরকারি কাগজ-কলমে মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে পদপ্রাপ্ত। কিন্তু আমাদের ডোম বলে ডাকে। এই শব্দে সরকারি খাতায় কোনো পদ নেই। মানুষের মুখে মুখে শব্দটি ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজের মানুষ আমাদের দেখে আড় চোখে তাকায়। কিন্তু আমরা তো মানুষ, আমাদের পরিবার আছে। সন্তানরা লেখা পড়া করে, স্কুল-কলেজে যায়।

আলীর সন্তানরা বিয়ে করেছেন। তিনি এখন নানা-দাদা দুটোই। তার ছোট ভাই মোবারক-চন্দনের চেলে মেয়েরা স্কুল-কলেজে লেখা পড়া করে।

লাশ কাটার কাজকে সমাজের কিছু শ্রেণি অসম্মান করলেও আলী, মোবারক, চন্দন কাজটিকে ভালোবেসে ফেলেছেন। কাজটিকে সম্মানও করেন তারা। পাশাপাশি দেশ ও সমাজের মানুষকেও ভালোবাসেন।

৪০ বছর ধরে লাশ কেটে আসছেন আলী। দেশের বড় বড় ট্র্যাজেডিতে নিহত মানুষের লাশ কেটেছেন তিনি। তালিকায় আছে তাজরিন, রানা প্লাজা, পুরান ঢাকায় আগুনের ঘটনায় নিহতদের লাশ কাটার অভিজ্ঞতা। আর কয়েকদিন পর অবসরে যাবেন। তিনি বলেন, চাকরির মেয়াদ আছে আর কয়েকবছর। শেষ হলে ছোট ভাইদের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যাবো। এখন তারা আমার তত্ত্বাবধায়নে এ কাজ করে।

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের যত সরকারি হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ আছে, প্রায় সবগুলোতেই সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত লাশ কাটার লোকজন রয়েছে। কিন্তু তারা কোনোদিন কোনো দাবি নিয়ে আন্দোলন করেননি। আলী বলেন, কত মানুষের লাশ মার্গে পাঠায় পুলিশ। নিহতদের আত্মীয়রা উদ্বিগ্ন থাকেন; কখন ময়নাতদন্ত শেষ হবে। কখন লাশ নিয়ে ফিরবেন, কখন দাফন করবেন। কখনও কখনও তাদের আচার ব্যবহারে কষ্ট পাই। কিন্তু আমরা কখনও তাদের কষ্ট দেই না। ময়নাতদন্ত দ্রুত শেষ করি, লাশ নিয়ে তারা চলে যান।

পচা-গলা লাশ মর্গে আসে, পোকা ধরা থাকে, প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়ায়। আমাদের কিন্তু কোনো সমস্যা হয় না। নিয়ম অনুযায়ী ফরেনসিক চিকিৎসকের উপস্থিতিতে এসব লাশ কাটি। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করেন। হতে পারে লাশগুলো কারও বাবার, কারও মায়ের বা ভাই-বোন অথবা কাছের আত্মীয়ের। তারা কিন্তু পচা-গলা লাশ নেন না। কারণ, শরিয়া অনুযায়ী আমরা এসব মরদেহের গোসল করাই, কাফন পরিয়ে দিই। অথচ মানুষ আমাদের ডোম বলে যাকে। আমাদের গুরুত্ব দেয় না। ডোম বলতে কোনো পদ নেই, কোথা থেকে এসেছে তাও জানি না।

আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া সময় অথবা পরিবারের লোকদের নিয়ে ঘুরতে বের হলে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়। তারা অন্যদের দেখিয়ে বলে ‘ওই যে ডোম’। পথচারী, এলাকার মানুষ ডোম শব্দ শুনে আমাদের দিকে অন্য নজরে তাকায়। এতে আমাদের পরিবার, সদস্য সন্তানরা কষ্ট পায়। আমরা সরকারি চাকরি করি, নিজেদের দায়িত্ব পালন করি। আমরাও মানুষ, মনে দুঃখ-কষ্ট আছে। আমরা এ সমাজের অংশ, আমাদের মানসম্মান আছে। আমাদের ডোম বলে ডাকবে না।

ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, সরকারি নথিতে ডোম বলে কোনো পদ নেই। যারা মর্গে কাজ করেন তারা মর্গ সহকারী হিসেবে পদপ্রাপ্ত। সরকারি নথিতে লেখা আছে মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট।

আলী, মোবারক ও চন্দনের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে আলী সরাসরি ঢামেক মর্গে নিয়োগপ্রাপ্ত। বাকি দুজনের মধ্যে একজন এনাটমি, অন্যজন মর্গ অফিসে নিয়োগপ্রাপ্ত। তিন ভাই-ই সরকারিভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। লোকবল কম থাকায় তিনজনই লাশ কাটার কাজ করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, ১৭ জুন, ২০২২
এজেডএস/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।