ফেনী: লোকটার কাজ মৃত মানুষ কাটা-কুটি। বুক বরাবর ছুরি চালিয়ে দু’ভাগ করে দিতে তার হাতটা একটুও কাঁপে না।
কাজে ভয় শঙ্কা কাটলেও বুকের ক্ষতটা কাটেনি আবদুর রহিমের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই আকালে মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতনে এই কঠিন কাজটি করছে মানুষটি। কোনো রকমে হাসপাতালের একটি খুপড়ি ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস। আক্ষেপ তার- আশায় আশায় ৩০টি বছর কেটে গেলো চাকরিটা আর সরকারি হলো না। এই আশাতেই জীবনটা পার হয়ে যায়। বলছি ২৫০ শয্যার ফেনী জেনারেল হাসপাতালের ডোম আবদুর রহিমের কথা।
রোববার (১২ জুন) হাসপাতালের মর্গের সামনে দেখা হয় রহিমের সাথে। ন্যায্য বেতন আদায়ের দাবিতে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করছিলেন তিনি। আন্দোলনের কর্মসূচি শেষে মর্গের সামনে দাঁড়িয়েই আলাপ জমে রহিমের সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপে উঠে আসছিলো রহিমের এক জীবনের উপাখ্যান। পাওয়া-না পাওয়া, একটা সরকারি চাকরীর জন্য অপেক্ষা ও এক জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার গল্প শুনতে শুনতে কেটে যায় ঘণ্টাখানেক।
রহিম জানাচ্ছিলেন, এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক বছর পর থেকেই তিনি ডোমের কাজ করছেন। চাকরির বয়স ত্রিশ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে হাসপাতালে কত ডাক্তার এলো গেলো, কত নার্স এলো গেলো। কত জনের ভাগ্য বদল হলো, শুধু তার কপালের চিত্রটাই পাল্টালো না। চাকরি করছেন মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতনে।
রহিম তার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে চোখের পানিও ঝরিয়েছেন। টানা ৮ বছর কোন বেতন ছাড়াই তিনি লাশ ঘরে চাকরি করেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো টাকাই তাকে দিতো না। মৃতদেহের আত্মীয়-স্বজন খুশি হয়ে যা দিতো তা দিয়ে কোনো রকমে তার সংসার চলতো। এরপর বেতন ধরা হলো ২ হাজার টাকা। পাঁচ বছর এ দুই হাজার টাকা দিয়েই চলে। ৩ হাজার টাকা বেতন পায় ৭ বছর, ৩২’শ টাকা বেতন মিলে চার বছর। গেল বছর অন্য সহকর্মীদের সাথে আন্দোলনের কারণে বেতন হয় ৬ হাজার টাকা।
রহিম জানান, হাসপাতালে ডোমের ২টি শূণ্যপদ থাকলেও তার চাকরি সরকারীকরণ হয়নি ৩০ বছরেও। বেসরকারিভাবে আউটসোর্সিং হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এখানেও চরম নির্যাতনের শিকার তিনি। কাগজে কলমে বেতন ২১ হাজার ৩’শ টাকা হলেও দেওয়া হয় মাত্র ৬ হাজার টাকা। বাকি টাকা যায় ঠিকাদারের পকেটে।
রহিম জানায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আলম ব্রাদার্স তাদের বেতন পরিশোধ করে। ঠিকাদার জানে আলম বেতন দেওয়ার সময় ব্ল্যাংক চেক ও স্ট্যাম্পে সই করিয়ে বেতন তুলে ৬ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকাটা তিনি নিয়ে যান। রহিম বলেন, এ কাজটা শুধু তার একার সাথে করা হয় না হাসপাতালের কর্মরত আরও ৫৩ জন কর্মচারীর সঙ্গেও করা হয়।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবুল খায়ের মিয়াজী ঠিকাদার জানে আলমের সঙ্গে ফোনে কথা বললে ঠিকাদার জানে আলম বেতন কম দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তিনি সব নিয়ম মেনেই বেতন দিচ্ছেন। তার সব ডকুমেন্টসও আছে। সরকারের কাছে থেকে চলতি বছর টাকা এখনও না পেলেও তিনি নিজের কাছ থেকে কর্মচারীদের বেতন চালিয়ে আসছেন।
দীর্ঘ জীবনে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে কষতে লাশ কাটা আবদুল রহিম বলছিলেন, যে ঘরটিতে থাকি জেল খানাও এর চাইতে ভালো আছে। সন্তানদের এখানেই মানুষ করেছি। অর্থাভাবে ছেলে-মেয়েদের খুব বেশি শিক্ষিত করতে পারিনি। কোন রকমে পেটে-ভাতে বড় করেছি। আশায় ছিলাম শেষ জীবনে হলেও চাকরিটা সরকারি হবে। ত্রিশ বছর চাকরি করেও একটা ছেলে এবং একটা মেয়েকে মানুষ করতে পারিনি, এই কষ্ট কোথায় রাখব!
চোখের এক কোনে পানি টলমল করছিলো, আকাশের দিকে তাকিয়ে রহিম বলছিলেন, সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখে না এই কাজকে, অনেকে ঘৃণা করে, সামাজিক কোনো মর্যাদাও নেই তবুও স্ত্রী সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে পেটের দায়ে করে যাচ্ছি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি নিয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কারণে এ পদে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই ডোমের কাজ করছেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। চাকরি স্থায়ী করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা করা সম্ভব হচ্ছে না।
হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক আবুল খায়ের মিয়াজী বলেন, পদ খালি পড়ে থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ। ইচ্ছে থাকলেও নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। লিখতে লিখতে কলমের কালি শেষ। সরকার নিয়োগ না দিলে আমাদের আর কী করার আছে।
কথা হয় আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ডোমদের বেতন কাঠামো বাড়াতে হবে। তাদের সরকারি চাকরি দিতে হবে। সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তাহলেই তারা আন্তরিকভাবে কাজ করবে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য তারা এসব কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না। সুযোগ সুবিধা পেলে রহিমের মত অন্যরাও কাজে আরো আগ্রহী ও মনোযোগী হতো।
বাংলাদেশ সময়: ২১১২ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২২
এসএইচডি