ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সাধারণের বাজেট ভাবনা

ব্যয় কমুক জীবনযাত্রার, সহনীয় থাকুক নিত্য-পণ্যের দাম

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৭ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২২
ব্যয় কমুক জীবনযাত্রার, সহনীয় থাকুক নিত্য-পণ্যের দাম

ফেনী: শহরের একটি বেসরকারি ব্যাংকে জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন আশিকুর রহমান। তার বেতন মাত্র ২৫ হাজার টাকা।

গত দুই বছরে তার বেতন না বাড়লেও সংসার খরচসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে। কোনোভাবেই ব্যয় সংকোচনের লাগাম হাতে নিতে পারছেন না তিনি।

শুধু আশিকুরই নন, সোনাগাজী উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন রবিউল হোসেন। ৩ বছর হয়ে গেছে তার চাকরির, বেতন মাত্র ১২ হাজার টাকা। গত এক বছরের তার বেতন বেড়েছে বেসিকের ৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬০০ টাকা। বেতনে জোর না থাকলেও ঘর ভাড়াসহ তার অন্যান্য ব্যয়ের জোর অনেক বেশি।

এ দুই পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলেছে বাংলানিউজ। জানতে চেয়েছে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বিশালাকারের বাজেটে অনুদান বাদে ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশের সমান। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সরকারি-বেসরকারি এ দুই পেশাজীবী বলেন, বাজেটের এত জটিল সমীকরণ বুঝতে চাই না, আমাদের মত চুনোপুঁটিরা এসবের খোঁজ না রাখলেও চলবে। প্রশ্ন একটাই- নিত্য-পণ্যের দাম কমবে তো?

সংসদে উপস্থাপিত বাজেট নিয়ে কথা হয় ফেনীর নানা শ্রেণি-পেশার আরও অনেকের সাথে। তারা জানিয়েছেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন শীর্ষক প্রস্তাবিত এ বাজেট নিয়ে জেলা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী মহলের ব্যক্তিদের মন্তব্যে দেখা গেছে তারতম্য। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া যায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

সরকার দলের নেতা ও ব্যবসায়ীরা বাজেটকে জন-বান্ধব বললেও বিএনপি-জামাত ও তাদের সমর্থিত ব্যবসায়ীরা এটিকে গণ-বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন। আর পেশাজীবী নেতারা বাজেটকে উন্নতি অগ্রগতির ধারাবাহিকতা মনে করলেও কেউ কেউ এটা নির্বাচনী বাজেট বলে গণ্য করছেন। তবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারের কাছে তাদের চাহিদা একটাই; জিনিসপত্রের দাম যেন কমে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা তারা।

ঘাটতি বাজেট নেতিবাচক নয়
বাজেটের সামগ্রিক বিষয়ে কথা হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ফেনী ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর তায়বুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটা দেশ উন্নয়নের দিকে থাকলে ঘাটতি বাজেট করতে হয়। ঘাটতি বাজেট না হলে উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যায় না। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন এবারের বাজেট সামগ্রিকভাবে সবার জন্য ইতিবাচক।

উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখা এবং কোভিড পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা দরকার এ বাজেটে মোটামুটি সে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছে বলে মনে করেন প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ।

পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা একদিক থেকে ইতিবাচক দেশের টাকা দেশে ফিরে আসছে। অন্যদিক দিয়ে এটি সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, যারা অবৈধ পন্থায় টাকা আয় করে বিদেশে পাচার করেছে এ প্রক্রিয়ার তারা উৎসাহিত হবে। এবং যারা সব নিয়ম মেনে বৈধ পন্থায় আয় করেছে তারা অনুৎসাহিত হবে।

অর্থনীতির প্রবীণ এই শিক্ষক আরও বলেন, বড় টার্গেট এবং বড় বাজেট এটা ঠিকই আছে। উন্নয়নমুখী একটা রাষ্ট্রের বাজেটের বৈশিষ্ট্য এমনই হয়।

জনমুখী-গণ-বিরোধী
প্রস্তাবিত এ বাজেটকে জনমুখী বাজেট হিসেবে উল্লেখ করতে চাইছেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এ. কে শহীদ খোন্দকার বলেছেন, করোনার কারণে বিগত কয়েকটি বছর সারাবিশ্বই খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিল। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখেই সরকার এই বাজেট ঘোষণা করেছে। সামগ্রিকভাবে চ্যালেঞ্জিং বাজেট মনে হলেও এটি একটি জনমুখী বাজেট। এই বাজেটের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি নতুনভাবে চাঙা হবে। এই বাজেট বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুগুণে সমৃদ্ধ হবে।

অপরদিকে প্রস্তাবিত এ বাজেটকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ফেনী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, এটি গণ-বিরোধী বাজেট। বাংলাদেশের ইতিহাসের রেকর্ড ঘাটতি বাজেট। সরকারের কোনোভাবেই সাধারণ জনগণের দিকে নজর দেয়নি। লোন নির্ভর বাজেট , যেকোনো সময় অর্থনৈতিকভাবে দেশ ভেঙে পড়বে। বাজেটে সরকার একটি বিষয় অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে।

ব্যবসা-বান্ধব কিনা- রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
প্রস্তাবিত এ বাজেটটি ব্যবসা-বান্ধব কিনা এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একটা অংশ বলছেন এটি ব্যবসা-বান্ধব, আরেকটা অংশ বলছে এ বাজেটে ব্যবসায়ীদের উপর চাপ বেড়েছে।

কথা হয় ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাট্রিজের সভাপতি আইনুল কবির শামীমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই বাজেটকে আমরা ব্যবসা-বান্ধব বাজেট মনে করি। আমরা আরও আশা করবো বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকবে। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে অচলাবস্থায় ছিল এ বাজেটেরে কারণে ব্যবসা-খাত আরও বহুগুণে সচল হবে।

তবে এক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেন ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাট্রিজের সাবেক সভাপতি ও স্টার লাইন গ্রুপের পরিচালক জামাল উদ্দিন। তিনি মনে করেন, এ বাজেট পুরোপুরি ব্যবসা-বান্ধব নয়। এ বাজেটে ব্যবসায়ীদের উপর চাপ বাড়বে। বাজেটে বিশাল অংকের রেভিনিউ আদায়ের টার্গেট ধরা হয়েছে, যা অনেকটাই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে। সরকার যদি সচেতনভাবে বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বাজেট দিত তাহলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হতেন।

নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য সুখবর নেই
বাজেটের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবিসি টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিবেদক আদিত্য আরাফাত বলেন, এবারের বাজেটেও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য তেমন সুখবর নেই। মধ্যবিত্তের জন্যও সুবিধার নয় বাজেট, তবে ধনী শ্রেণির মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। এ বাজেটকে জন-বান্ধবের চেয়ে ব্যবসায়ী-বান্ধব বলাই বেশি যুতসই। নানা সুবিধা দেয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের। সামগ্রিকভাবে এ বাজেটে দেশের অর্থনীতিকে মোটাতাজা করার চেষ্টার চিত্র দেখা যায় তবে তা মেটাতে সক্ষমতার প্রশ্ন রয়েছে।

আইটি পণ্যে কর বৃদ্ধি নয়
বাজেটে আইটি সেক্টরের বিষয়টি জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের প্রেসিডেন্ট ও বেসিসের সাবেক পরিচালক আরিফুল হাসান অপু বলেন, করোনাকালীন সময়ে মানুষ জেনেছে আইটি খাত কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। এই একটি খাতের উপর নির্ভর করেই তখন দেশ চলেছে। আর সে কারণে ইন্টারনেট, মোবাইল ও কম্পিউটার এসব নিত্য-পণ্য হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বর্তমান প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি করা কম্পিউটার ও ল্যাপটপের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব, অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল আমদানিতে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব,  ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ ভ্যাট প্রস্তাব, খুচরা বাজারে মোবাইল ফোন বিক্রির ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার প্রস্তাব বিবেচনা করা দরকার বলে আমার মনে হয়। এর কারণে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম বাড়বে এবং ডিজিটাল ডিভাইস দাম বাড়ার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।

তবে গতবারের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে ২৭৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এক হাজার ৯১৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটিকে ইতিবাচক মনে করছেন এই আইটি বিশেষজ্ঞ।

শিক্ষাখাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে
প্রস্তাবিত এ বাজেটে শিক্ষাখাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ তপু। তিনি বলেন, আসন্ন ২০২২–২৩ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আসন্ন অর্থবছরে মোট ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিই প্রমাণ করে বর্তমান সরকার শিক্ষা-বান্ধব।

চলতি অর্থবছরে এই দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। যা বাড়িয়ে আসন্ন অর্থবছরে মোট ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে আমরা শুনতাম শিক্ষাঙ্গনে বোমা সন্ত্রাস। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কলম তুলে দেওয়া হয়। নতুন বছরে নতুন বই দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, ১২ জুন, ২০২২
এসএইচডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।