ঢাকা, সোমবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ মে ২০২৪, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

তামাকপণ্যে লাগাম টানবে উচ্চ করারোপ

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৯ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২২
তামাকপণ্যে লাগাম টানবে উচ্চ করারোপ

ঢাকা: একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সাজিদুর রহমান। রাজধানীর মতিঝিলে সহকর্মীদের সঙ্গে মেসে থাকেন।

স্ত্রী-সন্তান থাকেন গ্রামে। বিগত ২৫ বছর যাবত মধ্যম স্তরের একটি ব্র্যান্ডের সিগারেট দিয়ে ধূমপান করেন তিনি।

ধূমপানে আসক্তির প্রথম দিকে দিনে ১০ শলাকার তিন প্যাকেট সিগারেট লাগতো তার। কয়েক বছর পর তা কমে এসেছে দুই প্যাকেটে এখন সারাদিনে তার এক প্যাকেট সিগারেট হলেই চলে। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সিগারেট গ্রহণের মাত্রা আরও কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে এই ধূমপায়ীর।  

সাজিদুর রহমান জানান, দাম বাড়ার কারণে বাধ্য হয়েই তিনি সিগারেট কমিয়েছেন। যা বেতন পান তা দিয়ে পরিবারের সব খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ব্যয় কমাতেই সিগারেট কমাতে হয়েছে। তিনি মনে করেন সিগারেটেরে ওপর উচ্চ করারোপ করলে ধূমপান আরও কমবে। তবে দাম বেড়ে যাওয়ার ধূমপানের মাত্রা কমে যাওয়ার বিষয়টাকে ইতিবাচক ভাবেই দেখছেন তিনি।

শুধু এই একজনই নয়, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী ও ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত এমন আরও ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের মতামত পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৪ জন জানান, দাম বাড়ার কারণে ধূমপান কমিয়ে দিয়েছেন, ৩ জন সিগারেট ছেড়েই দিয়েছেন, আর ২ জন ডাক্তারের পরামর্শে ছেড়েছেন। বাকি ১ জন দাম বাড়ার কারণেও ধূমপানের মাত্রা কমাননি।

তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে কর বাড়িয়ে তামাক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি একটি আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত পদ্ধতি। দেশে তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোর একাধিক গবেষণাতেও উঠে এসেছে অতিরিক্ত করারোপের কারণে তামাকের ব্যবহার হ্রাসের চিত্র।

সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক প্রাক-বাজেট সংবাদ সম্মেলনে উন্নয়ন সমন্বয়ের পরিচালক (গবেষণা) আবদুল্লাহ নাদভী তার প্রবন্ধে বলেন, সিগারেটের দাম বাড়ানো হলে ৭১ শতাংশ মানুষ আগের মতো ধূমপান অব্যাহত রাখতে খাদ্য বাবদ ব্যয় কমাবেন না।

তিনি আরও বলেন, সিগারেটের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো গেলে ৩০ শতাংশ মানুষই ধূমপান ত্যাগের চেষ্টা করবেন। আরও ৩০ শতাংশ মানুষ কমিয়ে দেবেন। ২০২১-এর  নভেম্বরে  দেশের পাঁচটি জেলার ৬৫০টি তামাক ব্যবহারকারী নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর এই জরিপ চালানো হয়।

তামাকপণ্যের দাম বাড়লে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা কমে এটা প্রমাণিত। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস)-২০১৭ অনুযায়ী, ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে অর্থাৎ ৮ বছরে বাংলাদেশে একজন বিড়ি ব্যবহারকারীর এ বাবদ মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। একই সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিড়ির ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে ৫৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়ানো হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খুব সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো দেশ এভাবে ঘোষণা দিয়ে তামাক নির্মূলের কথা বলেনি। প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জটা নিয়েছেন। তিনি এমন একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই উদ্যোগ নিয়েছেন, যে দেশ পুরো বিশ্বের মধ্যে তামাক চাষে ৯ম স্থানে অবস্থান করছে। ৩৫.৩ শতাংশ মানুষ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষ (১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব) তামাক ব্যবহার করেন।

প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে যখন পরবর্তী দুই দশকের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন, তখন তা অর্জনের জন্য ‘বর্তমান শুল্ক কাঠামো সহজ’ করা এবং ‘এ অঞ্চলের সর্বোত্তম ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের শুল্ক আয় বৃদ্ধি করা’র নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশে বিদ্যমান বহুস্তর বিশিষ্ট জটিল ও কঠিন কর কাঠামো প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে কতটুকু সহায়ক তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কর কাঠামো এখনও সহজ হয়নি।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত বলেন, আমাদের দেশে তামাকের কর ও রাজস্ব ইস্যুতে প্রচলিত কিছু ভুল জনশ্রুতি রয়েছে। তামাক হতে প্রতি বছর গড়ে সরকার রাজস্ব আয় করে ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। তামাক পণ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বারবার এই বিষয়টিকে সামনে আনতে চান। কিন্তু খেয়াল করতে হবে, তামাকপণ্য ব্যবহারের কারণে চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানো বাবদ সরকারের ক্ষতি হয় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। যা রাজস্ব আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

সাধারণ পর্যবেক্ষণে মনে হতে পারে বাংলাদেশে সিগারেটের ওপর করের হার বেশি, তবে সারা বিশ্বে যেসব দেশে সস্তায় সিগারেট পাওয়া যায় এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম একটি। কারণ এখানে উৎপাদন ব্যয় এবং শ্রম সস্তা।

বিশ্বের কয়েকটি দেশের দিকে লক্ষ্য করলেই আমরা বিষয়টি খেয়াল করতে পারব। ডব্লিওএইচও রিপোর্ট অন দ্যা টোব্যাকো প্যানডেমিক-২০২১ এর মতে, শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বিক্রি হওয়া সিগারেটে করের হার ৭২ শতাংশ। যার প্রতি  প্যাকেটের (২০শলাকা) খুচরা মূল্য (আন্তর্জাতিক ডলারে) ২৪.৯২ মার্কিন ডলার। সেখানে বাংলাদেশে ৭৩ শতাংশ করের হারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া এক প্যাকেটের খুচরা মূল্য ২.৯১ ডলার।

নিউজিল্যান্ডে ৮২ শতাংশ  কর হারের প্রতি প্যাকেটের মূল্য ২০.৪৪ ডলার। অস্ট্রেলিয়ায় ৭৪ শতাংশ কর হারের প্রতি প্যাকেটের মূল্য ১৯.৭৭ ডলার। ভূটানে ৮ শতাংশ কর হারের প্রতি প্যাকেটের দাম ১৭.৭৭ ডলার। এখান থেকে সহজেই বোঝা যায় আমাদের দেশে কর হার বেশি মনে হলেও সব চেয়ে সস্তায় সিগারেট বিক্রি হয় এদেশেই।

সিগারেটের কর সংক্রান্ত স্কোরকার্ডে সেরা দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্কোর ২.৬৩ (৫ এর মধ্যে)। ১৬০টি দেশের সিগারেট করনীতির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েস শিকাগোর (ইউআইসি) হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইনস্টিটিউটের অধীনে টোব্যাকোনমিকস এই স্কোর কার্ড প্রকাশ করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্যমতে, সবচেয়ে কমদামে সিগারেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫টি দেশের মধ্যে ১০৭ তম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সবচেয়ে কমদামি সিগারেটের মূল্য বাংলাদেশের কমদামি সিগারেটের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। অন্যান্য তামাকদ্রব্যও তুলনামূলক খুবই সহজলভ্য এখানে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেন, তামাকের ব্যবহার কমাতে সব তামাকপণ্যের ওপর যথাযোগ্য কর আরোপই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। প্রধানমন্ত্রী তামাকমুক্ত দেশ গড়ার যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন, সেখানেও তামাকপণ্যের বর্তমান শুল্ক কাঠামো সহজ করার মাধ্যমে তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিক্রি থেকে পাওয়া রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানোর নির্দেশনা ছিল।

এ প্রসঙ্গে তামাক বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক ও গবেষক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, বাংলাদেশে প্রতি শলাকা সিগারেটের মূল্য ৫০ টাকা হওয়া উচিৎ। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে তামাকের করকাঠামো অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। আন্তর্জাতিক কর কাঠামোর ধারে কাছেও নেই আমাদের দেশের তামাকের এই কর কাঠামো। তিনি বলেন, তামাকের ওপর নির্ভর করে আমাদের অর্থনীতি নির্ভর করতে পারে না। এর বিকল্প উৎস আমাদের খুঁজে নিতে হবে।

মাদক দ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা-মানস এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. অরুপ রতন চৌধুরী বলেন, তামাক সারা পৃথিবীর জন্য আরেক মহামারি। প্রতিবছর ৮০ লাখ মানুষ তামাকের কারণে মারা যান। প্রতি সেকেন্ডে মৃত্যু হয় একজনের। তিনি বলেন, আমরা আসন্ন বাজেটে সরকারকে কর বাড়ানোর প্রস্তাবনা দিয়েছি। সরকারের উচিৎ আমাদের বিষয়টা বিবেচনায় নেয়া।

সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ বলেন, বাংলাদেশে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন, ধূমপান না করেও প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্ন পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।  
বর্তমান তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল যা তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণের পথে একটি বড় বাধা। আর এজন্য এই কর কাঠামোকে সহজ করতে হবে। এটা করে যথাযথ পদ্ধতিতে তামাক-কর বৃদ্ধি করলে তামাকের ব্যবহার কমাতে তা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।

সিটিএফকে-বাংলাদেশের লিড পলিসি অ্যাডভাইজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণের ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। ক্যান্সার, হৃদ রোগসহ জটিল আরো অনেক রোগ হয়। কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়ে এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, ৩১ মে,
এসএইচডি/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।