ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

জুয়া খেলায় মোবাইল হারিয়ে নিখোঁজ ১২ বছর!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২২
জুয়া খেলায় মোবাইল হারিয়ে নিখোঁজ ১২ বছর! কথা বলছেন সুমন।

ঢাকা: মিরপুরে শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে ডায়মন্ড প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন মো. সুমন। একদিন বাসায় ফেরার পথে জুয়া খেলে শখের মোবাইল ফোন খোয়ান তিনি।

মোবাইল ফোন খুইয়ে বাসায় ফিরতে ভয় পান, আর তারপর থেকে প্রায় ১২ বছর তিনি ফেরেননি।  এরপর কখনো রাত কেটেছে বায়তুল মোকাররম মসজিদের বারান্দায় কখনো বাসে, কখনো ফুটপাতে। কাজ করেছেন ফুলের মার্কেটে, বাসের হেলপার, হোটেলের বাবুর্চি হিসেবে। চটপটি কিংবা পপকর্নের ব্যবসাও করেছেন সুমন। সর্বশেষ বাসের ড্রাইভিং পেশায় যোগ দেন।

এরমধ্যে নিখোঁজ সন্তান সুমনের সন্ধানে বাবা মোজাফফর হোসেন থানায় জিডি করেন, মামলা করেন। তদন্তভার থানা, ডিবি, সিআইডির হাত বদলে সর্বশেষ আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। কিন্তু ১২ বছরে কেউ সন্ধান দিতে পারেননি নিখোঁজ সুমনের। সুমনও স্ব-উদ্যোগে ফেরেননি পরিবারে। তবে, সর্বশেষ সুমনের স্ত্রীর সহযোগিতা আর পিবিআইর তদন্তে নিখোঁজ সুমন ফিরে আসেন পরিবারে।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মো. জাহাঙ্গীর আলমের তদারকিতে সোমবার (২৩ মে) সন্ধ্যায় রাজধানীর কদমতলী থানাধীন মদিনাবাগ এলাকা থেকে সুমনকে উদ্ধার করা হয়।

মঙ্গলবার (২৪ মে) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁও ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান এসএসপি জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেন, ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট সকাল ৮টায় বাবা মোজাফ্ফর (৫২) ছেলে সুমনকে (১৭) নিয়ে বাসা থেকে তার কর্মস্থল ডায়মন্ড প্যাকেজিং গার্মেন্টসে যান। এরপর সুমন আর বাসায় ফেরেননি। বাবা মোজাফ্ফর ছেলের সন্ধান চেয়ে ৫ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি জিডি করেন। এরমধ্যে বাবা মোজাফফরের কাছে তথ্য আসে সোলায়মান হোসেন (২৮), শাওন পারভেজ (১৮), রুবেল (২০), সোহাগ (২০) ও মানিক (২৫) নামে ক’জন মিলে ছেলে সুমনকে অপহরণ করেছেন। এতে সন্দেহবশত বাদী হয়ে ২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন তিনি।

মামলার তদন্ত পল্লবী থানা পুলিশের হাত ঘুরে সে বছরের ৩০ অক্টোবর ডিবি পুলিশের হাতে যায়। ডিবির পরিদর্শক আয়নাল হক ভিকটিমের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করেন। মামলার এজাহারনামীয় সোলাইমান, পারভেজকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করেন। কিন্তু সুমনের খোঁজ মেলেনি। পরে ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের আদেশে মামলাটির তদন্তভার সিআইডির ওপর অর্পণ করা হয়। অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিদের নির্দোষ হিসেবে সিআইডি চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করলে বাদীর নারাজী আবেদন করেন।

আদালতের নির্দেশে পুনরায় ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই মামলাটি ডিবিতে ন্যস্ত করা হয়। ডিবির পরবর্তী তদন্তে বরাবরের মতো বাদী আবারও নারাজি দেন। আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তভার যায় পিবিআইতে।

পিবিআইর এ কর্মকর্তা বলেন, মামলার ভিকটিম সুমন নিখোঁজ হওয়ার ১১ দিন পর একটি মোবাইল নম্বর থেকে বাদীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সে সময় ভিকটিমের অবস্থান সর্ম্পকে জানতে চাইলে কোনো উত্তর না দিয়েই ফোনটি রেখে দেয়। এরপর হতে মোবাইল নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর জানা যায়, নম্বরটি শাহবাগ থানার সামনে ফ্লেক্সিলোডের দোকানের। অনেক লোকজন দুই টাকা মিনিটে কথা বলতো ফোনে, তাই কে কখন কল করেছিলেন তা দোকানদার শনাক্ত করতে পারেননি।

অপহরণের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ভিকটিম সুমনকে উদ্ধার করতে না পারলেও পিবিআই ভবিষ্যতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে উল্লেখ করে চলতি বছরের ৯ মার্চ পল্লবী থানার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন।

এর মধ্যে ভিকটিমের সন্ধান মেলে। ২৩ মে পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম আদালতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন। আদালতের নির্দেশে পুনরায় মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআই। তদন্তকারী বিশেষ টিম তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ভিকটিম সুমনকে শনাক্তপূর্বক ২৩ মে রাতে কদমতলী থানাধীন মদিনাবাগ এলাকা থেকে উদ্ধার করে।

ভিকটিম নিখোঁজ সুমন জানান, তিনি শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুরে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ডায়মন্ড প্যাকেজিংয়ে হেলপার হিসেবে কাজ করেন। ঘটনার দিন মিরপুর-১১ নম্বর বাজার এলাকার চার রাস্তার মোড়ে ৩ তাসের জুয়া খেলায় ১শ টাকা ধরে হেরে যায়। তার কাছে টাকা না থাকায় জোরপূর্বক তার মোবাইল ফোন জুয়ারিরা রেখে দেয়।

মোবাইলের বিষয়ে বাবাকে কী উত্তর দেবেন? এ ভয়ে বাসায় না ফিরে মিরপুর থেকে গুলিস্থান যায়। সারাদিন গুলিস্থানে ঘোরাফেরা করে। রাতেও বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করে। পরদিন সকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদে শুয়ে থাকেন।

এরপর থেকে পরিবারের কাছ থেকে নিখোঁজ থাকা সুমন বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রায় ৩ বছর আগে জোসনাকে বিয়ে করেন, এর মধ্যে তাদের একটি ছেলেও হয়। স্ত্রীকে নিয়ে রায়েরবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে আসছিলেন সুমন।

এসএসপি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যে সময় সুমন নিখোঁজ হয় তখন তার বয়স ছিল ১৬। আজ তার বয়স ২৮। ১৬ বছরের এক তরুণের মোবাইল খোয়ানোয় ভয়ে আতঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে পরিবারের উচিত আরও সহনশীল হওয়া।

এদিকে চোরাই মোবাইল দিয়ে নানা অপকর্ম হয়। চোরাই মোবাইল কিনে ব্যবহারের কারণে সোলাইমান নামে ব্যবসায়ীকে জেলে যেতে হয়েছে। যদিও আজ এই মামলায় সব আসামিই নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২২
পিএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।