ঢাকা, রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১২ মে ২০২৪, ০৩ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

মুক্তিপণের টাকায় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হতে চেয়েছিলেন ল্যাংড়া মামুন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২২
মুক্তিপণের টাকায় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হতে চেয়েছিলেন ল্যাংড়া মামুন রাজধানীর ভাটারা ও গুলিস্তানে অভিযান চালিয়ে অপহরণ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ

ঢাকা: ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের অপহরণের পর আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন মুফতি মামুন ওরফে ল্যাংড়া মামুন। শুধু তাই নয়, নিজের ভগ্নিপতির লাখ লাখ টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়ে বরিশালের পটুয়াখালী শহরে একাধিক দোকান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান এই অপহরণকারী।

এক সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডান পা হারান তিনি। কিন্তু অপকর্মে দমে যাননি তিনি। ল্যাংড়া মামুনের দুটি টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

পটুয়াখালীতে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পোশাক কারখানা করার পরিকল্পনা ছিল ল্যাংড়া মামুনের। সেই পরিকল্পনা বাস্তাবায়ন করতে গত ১১ এপ্রিল রাতে পটুয়াখালীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শিবু লালকে অপহরণ করেন তিনি। ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন ল্যাংড়া মামুন।

অপহরণের পরের দিন ১২ এপ্রিল রাতে হাত-পা, মুখ বাঁধা ও বস্তাবন্দি অবস্থায় তারই মার্কেট ভবন এসপি কমপ্লেক্স শপিং সেন্টারের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে ব্যবসায়ী শিবু লাল ও তার গাড়ি চালককে উদ্ধার করে পটুয়াখালী জেলা পুলিশ। ওই ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে পটুয়াখালী জেলা পুলিশের অনুরোধে তদন্ত শুরু করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ।

তদন্তের পর মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) রাজধানীর মিরপুর, ভাটারা ও গুলিস্তান এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা ল্যাংড়া মামুন ওরফে মুফতি মামুনসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে ডিবি গুলশান বিভাগ।

চক্রের গ্রেফতার অন্যরা হলেন—ল্যাংড়া মামুনের সহযোগী পিচ্চি রানা, বিআরটিসির গাড়ি চালক জসীম উদ্দীন ও আশিকুর রহমান। অভিযানে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার, মোবাইল ফোন, গামছা ও চার হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়।

বুধবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) কে এম হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, প্রতারণা, অপহরণসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে পটুয়াখালী জেলা শহরে মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন এই ল্যাংড়া মামুন। তার অর্থের প্রধান একটি উৎস হলো মাদকের কারবার। মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখতেন তিনি।

এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, অপহৃত শিবু লাল দাস পটুয়াখালী জেলা শহরের পরিচিত ঠিকাদার, ইজারাদার, আড়তদার। এছাড়াও তার বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। তিনি পটুয়াখালীর একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী।

পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকতা বলেন, গত ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে শিবু লাল দাস গলাচিপায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে পাজেরো জিপে করে পটুয়াখালী শহরের বাসায় ফিরছিলেন। পথে তিনি ও তার গাড়িচালক নিখোঁজ হন। পটুয়াখালীর একটি পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় তার পাজেরো জিপ উদ্ধার করে জেলা পুলিশ। পরদিন ১২ এপ্রিল রাতে হাত-পা, মুখ বাঁধা ও বস্তাবন্দি অবস্থায় তাকে ও গাড়িচালককে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ১৯ এপ্রিল ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অপহরণকারী ল্যাংড়া মামুনসহ তার সহযোগীদের গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ।

হাফিজ আক্তার বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা অপহরণের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানান, চলতি বছরের গত ফেব্রুয়ারি মাসে পটুয়াখালী লঞ্চঘাটের পাশে ল্যাংড়া মামুনের গার্মেন্টস অফিসে বসে তারা শিবু লালকে অপহরণের পরিকল্পনা করেন। এতে অংশ নেন, পিচ্চি রানা, পাভেল ও বিআরটিসির চালক জসীম। পরে একাধিক বার মিটিং ও অপারেশনাল পরিকল্পনা করেন তারা। এই মিটিংয়ে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে যোগ দেন জসীম উদ্দীন ও তার ভাই গাড়ির দালাল আশিক মৃধা। আগাম দশ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে এক সপ্তাহের জন্য গাড়ি ভাড়া করেন তারা।

এছাড়া অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগসহ অপারেশনাল কাজে ব্যবহার করার জন্য সাভার থেকে কেনা হয় পাঁচটি বাটন মোবাইল ফোন। বেশি দাম দিয়ে কেনেন অন্যজনের নামে নিবন্ধন করা ৫টি সিম। এরপর একটি খেলনা পিস্তল, দুটি সুইচ গিয়ার, তিনটি চাপাতি ও গরু জবাই করার একটি বড় ছুরি সংগ্রহ করেন তারা। একাধিক বার তাকে অপহরণের রেকি করে। সবশেষ ১১ এপ্রিল রাতে ব্যবসায়ী শিবু লালকে অপহরণ করে ল্যাড়া মামুন চক্র।

হাফিজ আক্তার বলেন, ১১ এপ্রিল দুপুর বেলা পটুয়াখালী এয়ারপোর্টের কাছে মিলিত হন তারা। কে কী দায়িত্ব পালন করবেন তা নির্ধারণ করে দেন ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা। আর ভুক্তভোগীর গতিবিধি জানাতে পিচ্চি রানা মোটরসাইকেল যোগে ল্যাংড়া মামুনকে গলাচিপা ঘাটে নিয়ে যান। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য পটুয়াখালী-গলাচিপা হাইওয়ে রোডের শাঁখারিয়ার নির্জন জায়গায় একটা প্রাইভেট কার ও একটা ট্রলি নিয়ে অবস্থান নেন তাদের পাঁচ সহযোগী।

ল্যাংড়া মামুনের নির্দেশে আগে থেকেই একটি ট্রলি ভাড়া করেন চালক বিল্লাল। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া প্রাইভেটকারটি নিয়ে চালক আশিক মৃধা, পাভেল, হাবিব, সোহাগ এই চারজন অবস্থান নেন। ল্যাংড়া মামুনের সংকেত পাওয়ার পরপরই রাত সাড়ে ৮টার দিকে ড্রাইভার বিল্লাল ট্রলিটি নিয়ে সুকৌশলে ভুক্তভোগী শিবু দাসের জিপের সামনে আড়াআড়ি করে অবস্থান নেন। পিছন থেকে অনুসরণ করতে থাকা চালক আশিক তার প্রাইভেট গাড়িটি দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির পিছনে অবস্থান নিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। পরে আশিক প্রাইভেটকার ছেড়ে ভুক্তভোগী শিবু দাসের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেন। গাড়িতে উঠেই বিল্লাল, পাভেল, সোহাগ, আশিক বেঁধে ফেলেন শিবু লাল ও তার গাড়িচালককে। গামছা, টিস্যু পেপার ও স্কচ টেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে চালাতে থাকেন শারীরিক নির্যাতন।

পুলিশ কর্মকতা আরও বলেন, বরগুনার আমতলী এলাকার গাজিপুরায় গিয়ে ভুক্তভোগীর জিপ গাড়ি থেকে তাদের তোলা হয় ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া গাড়িতে। সেখানে দুজনকেই বেঁধে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢোকানো হয়। আর ভুক্তভোগীর জিপ গাড়িটি আমতলীর একটি ফিলিং স্টেশনে ফেলে আসেন তারা। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা পটুয়াখালীর বাঁধঘাট এলাকায় ভুক্তভোগীর বহনকারী গাড়ি বুঝে নেন। এইচডি রোডের নিজস্ব মেশিন ঘর কাম টর্চার সেলে নেওয়া হয় তাদের। পরে নিয়ে যাওয়া হয় এসপি কমপ্লেক্স সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্থায়ী সেলে। রাতভর চলে নির্যাতন।

পরের দিন রানার নির্দেশে বিল্লাল ভুক্তভোগীর সিম থেকে ভিকটিমের স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। মুক্তিপণের টাকা না দিলে এবং বিষয়টি পুলিশকে জানালে শিবু লালকে হত্যা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে বলেও সতর্ক করে দেন অপহরণকারীরা।

এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেফতার ল্যাংড়া মামুন অল্প বয়সেই জড়িয়ে পড়েন অপরাধ জগতে। ভগ্নিপতির টাকা মেরে পটুয়াখালী শহরে মালিক হয়েছেন একাধিক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষদের তার দুটি টর্চার সেলে আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন টাকা।

আসামিদের বিরুদ্ধে মাদক ও অপহরণের একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের নামে আরও একটি মামলা করা হবে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২২
এসজেএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।