ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

গৃহিণী থেকে সফল উদ্যোক্তা ‘কসাই’ জামিলা

শরিফুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫১ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০২২
গৃহিণী থেকে সফল উদ্যোক্তা ‘কসাই’ জামিলা

ঠাকুরগাঁও: জমিলা বেগম (৪৭)। জীবন সংগ্রামে তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শেষ সীমান্তে ঝাড়বাড়ি বাজারে ‘মায়ের দোয়া’ মাংস ভাণ্ডারে নিজ হাতেই মাংস কেটে বিক্রি করেন। প্রায় ২২ বছর এ কাজ করে তিনি সংসারের হাল ধরে রেখেছেন।  

কথা হয় জমিলার সঙ্গে। তিনি বলেন, স্কুলের পড়াশোনা শেষ না হতেই বাবা আমাকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন। আমার বাবা জাকির হোসেন আমার বিয়ে দেন বগুড়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম ভান্ডারীর সঙ্গে। তিনি পেশায় ছিলেন একজন কসাই। জমিলার বিয়ের পর প্রথম সন্তানের জন্ম পর্যন্ত ভালোই ছিলাম। কিছুদিন পরে আমার স্বামী নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একের পর এক সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এভাবেই স্বামীর ব্যবসা লাটে ওঠে। পরে স্বামীকে মাদক থেকে দূরে রাখতে ২০০০ সালের শেষ দিকে স্বামী-সন্তানসহ বীরগঞ্জে বাবার বাড়িতে আসি।  

তখন বাবার জমি বিক্রি করে স্বামীকে আবার বাজারে মাংসের দোকানে ধরিয়ে দিই। এভাবে কিছুদিন ভালোই চলল। তখন আমার এক ছেলে জহিরুল নবম শ্রেণিতে পড়তো। তখন আমি আবার অন্তঃসত্ত্বা হলাম। ঠিক তখনই আমার স্বামী টাকার লোভ সামলাতে না পেরে আমার বাপের জমি বেচা টাকা ও দোকানের টাকা সব মিলে প্রায় আড়াই লাখ টাকা ও আমাকে তালাক দিয়ে পালিয়ে যায়।  
এরপর শুরু হয় জীবনযুদ্ধ।

জমিলা বলেন, আমার স্বামী যখন আমাকে এভাবে ফেলে টাকা পয়সা নিয়ে চলে যায় তখন আমার খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল আমি নিজেকে শেষ করে দেই। কিন্তু ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর শেষ করতে পারলাম না। মনের মধ্যে জেদ চাপল স্বামী ছাড়াই ছেলে মেয়েদের নিয়ে সংসার করবো। পেছনের কথা চিন্তা না করে কিভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় সেই চিন্তা করতে শুরু করলাম আমি। তারপরে মনে মনে ঠিক করলাম এখন থেকে দোকানে আমি বসবো। কে কি বলে বলুক। মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম যে আমি একজন নারী হয়ে কিভাবে গরু কেটে মাংস বিক্রি করব। জেদ ও ইচ্ছে শক্তি মনোবল বাড়িয়ে দিল। শুরু করলাম দোকানে বসা প্রথমে হয়তো চাপাতি দিয়ে গোশত কাটতে খুব কষ্ট হতো। এভাবেই মাংস কেটে বিক্রি করতে শুরু করলাম। তবে অনেকে আমাকে খারাপ চোখে দেখত। আমি একজন নারী হয়ে বাজারে এসে গোশত কেটে বিক্রি করি অনেকেই এটি চাইত না। অনেকেই আমার বিরোধিতা করা শুরু করলো। এলাকার কিছু লোক থানায়, ইউনিয়ন পরিষদে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছিল। ওই সময় আবার কয়েকজন আমাকে সাপোর্টও দিয়েছিলেন।  

আমাকে নিয়ে হাট কমিটি ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত মানুষ অভিযোগ করে বিচার শালিস বসে আমি একজন মেয়ে হয়ে হাটে যেন মাংসের দোকান না করি। এ বিষয় নিয়ে আমাকে অনেকবার হাট কমিটি ইউনিয়ন পরিষদে বসতে হয়েছে। তখন আমার একটাই কথা ছিল আমি মেয়ে মানুষ হয়ে হাটে বসে মাংস বিক্রি করতে পারব না কেন। আমার সংসারের খরচ কি আপনারা দেবেন। মেয়েরা সব জায়গায় কাজ করতে পারে হাটে বসে মাংস বিক্রি করতে গেলে অপরাধ কেন। তবে ওই সময়কার অনেক মানুষের সাপোর্ট ও ভালোবাসা পেয়ে আজ আমি বড় কসাই হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। আজ আমি মনে করি আমি একজন সফল উদ্যোক্তা নারী কাসাই।

‘মায়ের দোয়া’ মাংসের ভাণ্ডার দোকানের মালিক আমি। আজ আমি গর্বিত এবং সুখী। তবে আমার চেষ্টাও ইচ্ছে শক্তি না থাকলে হয়তো আমি একজন সফল নারী কসাই হতে পারতাম না। আমি মনে করি বাংলাদেশের যেকোনো কাজ মেয়ে করতে পারবে যদি ইচ্ছাশক্তি সৎ থাকে। মেয়েদের যে কোনো কাজে আমাদের সমাজের যদি ফুল সাপোর্ট থাকে তাহলে হয়তো মেয়েরা আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।  

তিনি বলেন, আমার দোকানে এখন প্রতিদিন ক্রেতারা দূর-দূরান্ত থেকে আসে ঠাকুরগাঁও, বীরগঞ্জ খানসামা, নীলফামারী থেকে অনেক কাস্টমার এসে মাংস কিনে নিয়ে যান। এখন আমি প্রতিদিনই গড়ে চারটি থেকে পাঁচটি গরু জবাই করে বিক্রি করি। এখন আমার ছেলে জহুরুল ইসলাম (৩৩) আমাকে সহযোগিতা করে। এবং মা ও ছেলে মিলে দুজনেই বর্তমান দোকান পরিচালনা করি। আমার দোকানে ৮ জন কর্মচারীও আছেন।

আমার সততার কারণে আমি যখন গরু কিনতে বাজারে যাই গরু কেনার পর টাকা কম থাকলে পাইকাররা আমাকে বিশ্বাস করে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বাকিদের দিয়ে দিত। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম মানুষ এতোটা আমাকে ভালোবাসে আমার সততার কারণে। বর্তমান আমার এখানে যারা মাংস কিনতে আসেন তারা যেভাবে চান তাদের সেভাবে দেওয়ার চেষ্টা করি। সততা ভালোবাসার কারণে আমার দোকানেই মাংস কিনতে ক্রেতাদের ভিড় থাকে।

খানসামা থানার সহজপুর গ্রামের সোনালী ব্যাংকের অফিসার সোহরাব আলী জানান, জমিলা আসলে সত্যিকারে একজন প্রকৃত নারী উদ্যোক্তা এবং তিনি সফল হয়েছেন। আমি প্রায় ছুটির দিনে ঝাড়বাড়ী মায়ের দোয়া মাংসের ভাণ্ডার থেকে মাংস কিনি। এখানে আমরা আমাদের পছন্দমত মাংসটা কিনতে পারি। জমিলা ক্রেতাদের চাহিদা মতো মাংস দেওয়ার চেষ্টা করেন।

সহজপুর গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দ সালেহ আহমেদ বলেন, জমিলা ভাবির নামটা সবার মুখে মুখে থাকে। আশেপাশের কয়েকটা দোকান থেকে তিনগুণ বিক্রি হয় ভাবির দোকান থেকে। কারণ ভাবির ব্যবহারে ক্রেতারা সবাই মুগ্ধ।

বীরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল কাদের বলেন, জমিলা নারী কসাই হয়ে  বাংলাদেশে ইতিহাস তৈরি করেছেন। জমিলা আসলে একজন সত্যিকারের সফল নারী উদ্যোক্তা। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে জয়িতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।