ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিনের সন্তানদের

এইচ এম লাহেল মাহমুদ, ডিস্ট্রিক্ট কসেপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২
খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিনের সন্তানদের

পিরোজপুর: অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটছে ভাষা সৈনিক মো. জালাল উদ্দিন আহম্মেদের পরিবারের সদস্যদের। একমাত্র ছেলে হেলাল উদ্দিন রিকশা চালিয়ে কোনো রকম দিন কাটান।

পিরোজপুর শহরের মুচিপাড়া নামক স্থানে রয়েছে সামান্য একটু জমি। সেই জমিতেই ছোট একটি ঘরে বাস করেন তার রিকশাচালক একমাত্র  ছেলে। তবে বাবাকে নিয়ে গর্ব করেন তিনি।

তিনি জানান, তার বাবা ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিন গত ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এক ছেলে ও কামরুন্নাহার নিলু, নাজমুন নাহার ডলি এবং তানিয়া সুলতানা পলি নামে তিন মেয়ে রেখে গেছেন। এদের মধ্যে ডলি অত্যন্ত গরিব ও অসহায়। আর পলি স্বামী পরিত্যক্তা ও মানসিক প্রতিবন্ধী।  

তিনি আরও জানান, বাবা রেড ক্রিসেন্টে চাকরি করতেন। ভাষা আন্দোলনে গিয়ে তিনি জেল খেটেছেন, চাকরি হারিয়েছেন। পরে অত্যন্ত কষ্টে অর্ধাহারে ও অনাহারে দিন কাটিয়েছেন। প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। এটাই ছিল বাবার একমাত্র কষ্টের বিষয়। বাবা তার চাকরি হারিয়ে কষ্টে দিন কাটাতেন। আর এ কারণে স্থানীয়রা তাকে সর্বহারা জালাল বলে ডাকতেন।

সরেজমিনে জানা গেছে, ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিন আহম্মদের ওই জমিতে বসবাস করেন তার একমাত্র ভ্যানচালক ছেলে হেলাল উদ্দিন। পাশেই দুই বোন ডলি ও পলির বসবাস। এদের মধ্যে স্বামী পরিত্যক্তা  মানসিক প্রতিবন্ধী বোন পলি একটি ভাঙাচোরা ঘরে বাস করেন। সে ঘরে নেই চালা। চালার প্রতিটি টিন ভেঙে আকাশ দেখা যাচ্ছে। সামনেই মেয়ে  তানিয়া সুলতানা পলির কাঠ ও টিনের তৈরি ঘর। তার স্বামীও একজন রিকশাচালক। তবে বাড়ির সামনে হেলাল স্থাপন করেছেন বাংলা ভাষা শেখার একটি কেন্দ্র।

হেলাল উদ্দিন বলেন, তিনি যে রিকশাটি চালান তার ব্যাটারি ভালো নেই। ব্যাটারি কেনার সামর্থ্য নেই তার। ওই রিকশা চালিয়ে তার  (হেলাল) যে আয় হয় তা দিয়ে দুই ছেলে, এক মেয়েসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ জোগাতে হয়। দেখাশুনা করতে হয় অসুস্থ বোনকেও। এর আগে বসবাসের জন্য ছিলো না কোনো ঘরও। কিন্তু এক বছর আগে স্থানীয় এমপি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আমার এই অসহায়ত্বের কথা শুনে একটি ঘর দেন। সেখানেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে বাস করছি। ছোট বোন পলির ঘরটি ভাঙাচোরা। এই শীতে বাস করার জন্য কোনো পরিবেশ নাই। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিতে ভিজে যায়। বোনকে মাঝেমধ্যে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। আমি রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করি তা দিয়ে তাকেও সামান্য সহযোগিতা করি।  

হেলাল উদ্দিনের মেঝো বোন ডলি বলেন, আমার স্বামী পেশায় একজন রিকশাচালক। এক মেয়ে প্রতিবন্ধী, আর স্বামীও প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। পৈত্রিক (জালাল উদ্দিন) স্মৃতি ধরে রাখতে স্বামীর গ্রামের বাড়ির জমি বিক্রি করে এখানে একটি কাঠের ঘর তৈরি করেছি। সেখানে সন্তানদের নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি। এ পর্যন্ত সরকারি কোনো সাহায্য পাইনি।  

হেলাল উদ্দিন তার বসতঘরের সামনে স্থাপন করেছেন বাংলা ভাষা শিক্ষার একটি কেন্দ্র। সেখানে একটি কাঠের তৈরি কক্ষে সারি সারি করে রঙ-বেরঙ এর বাংলা ভাষার বিভিন্ন বর্ণ সাজানো হয়েছে।

তিনি জানান, করোনাকালে বিভিন্ন স্কুল বন্ধ থাকায় স্থানীয় গরিব পোলা-পানরা (ছাত্র-ছাত্রী) প্রাইভেট পড়তে পারে না। হেগো (তাদের) লেখা-পড়া বন্ধ। মোর (আমার) খাইতে কষ্ট অইলে অবে (হবে) কি? বাবা বাংলা ভাষাকে ভালো বাইসকা (ভালোবেসে) তার চাকরি খুয়াইছে, জেল খাটছে। আর আমি এই এলাকার অসহায় পোলা-পানের বাংলা ভাষা শেখার জন্য একটা (একটা) কিছু করবো না তা কেমনে অয় (হয়)? এই জন্য বাসার সামনে এই কেন্দ্রডা বসানো।

ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিনের পরিবারের ব্যাপারে জানতে স্থানীয় নারী নেত্রী শিরিন আফরোজের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, প্রায় দুই বছর  আগে আমি ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিনের ছেলে হেলাল উদ্দিনের রিকশায় করে শহর থেকে বাসায় ফিরছিলাম। তখন তার (হেলাল উদ্দিন) সঙ্গে পরিচয় হয়। তার বসবাস করার জন্য কোনো ঘর না থাকার বিষয়টি তিনি আমাকে জানান। আমি বিষয়টি স্থানীয় এমপি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে জানালে তিনি একটি পাকা ঘরের ব্যবস্থা করে দেন। সেই ঘরেই তিনি (হেলাল) বর্তমানে বসবাস করছেন।

তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিনেও তার পরিবারের খোঁজ নেয়নি কেউ। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিন ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে যান। পরে জেলে বসেও ভাষা আন্দোলনের জন্য জনমত গড়ে তোলেন। সেখানে বসে স্লোগান তুললে জেল কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন।  

ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিনের পরিবারের সমস্যার বিষয় জানতে পিরোজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বশির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ভাষা সৈনিকের একমাত্র ছেলের সমস্যার কথা শুনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর নির্দেশে তাকে বসবাসের জন্য একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। অন্যদের সমস্যার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।   বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।