ঢাকা, সোমবার, ৪ আষাঢ় ১৪৩১, ১৭ জুন ২০২৪, ০৯ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

বগুড়ায় অবৈধ ইট ভাটার ছড়াছড়ি

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২২
বগুড়ায় অবৈধ ইট ভাটার ছড়াছড়ি

বগুড়া: বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে প্রায় দুই শতাধিকের বেশি ইট ভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ইট ভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন লঙ্ঘন করেই এসব ভাটা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

শনিবার (২৯ জানুয়ারি) বগুড়া জেলা প্রশাসন ও ইট ভাটা মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, গেল দুই বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে জেলার পৌরসভা এলাকাগুলো থেকে প্রায় ৪৫টির মতো ইট ভাটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।

জানা যায়, ইট ভাটা থেকে দূষণ কমানোর লক্ষ্যে পুরাতন পদ্ধতির ইট ভাটার পরিবর্তে জ্বালানী সাশ্রয়ী ও আধুনিক প্রযুক্তির পরিবেশ বান্ধব ইট ভাটা স্থাপনের লক্ষ্যে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধিত-২০১৯) এর ৪ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া কোনো ইট ভাটা চালানো যাবে না। ফলে বগুড়া জেলায় বর্তমানে যে সমস্ত ইট ভাটা রয়েছে সেগুলো আর বৈধ হওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া এ আইনে সনাতন প্রযুক্তির ১২০ ফুট চিমনি বিশিষ্ট ইট ভাটায় ইট উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ব্যত্যয় হলে দুই বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ইট ভাটা নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিএসটিআই, স্থানীয় ভূমি অফিসসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থার ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক।

এদিকে জেলা প্রশাসন, ইট ভাটা মালিক সমিতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে হাইকোর্টে রিট থাকায় এর আগে ইট ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তবে রায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে পাওয়ায় এখন পর্যায়ক্রমে এগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দাবি করা হয়েছে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের এ পর্যন্ত জেলায় প্রায় ৪৫টি ইট ভাটা উচ্ছেদ করা হয়েছে।

এই ভাটাগুলো কোন না কোন ভাবে লাইসেন্স নিয়েই তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনের কারণে এগুলোর আর বৈধ থাকার সুযোগ নেই। সে সময় তাদেরকে ২ বছর সময় দেওয়া হয়েছিল ভাটা উপযুক্ত স্থানে এবং পরিবেশ সম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে স্থাপন করার জন্য। কিন্তু তারা আইন না মেনে নিজেদের মতো ভাটা পরিচালনা করছিলেন।

জেলার দুই শতাধিক ইট ভাটার মধ্যে শুধু শাজাহানপুর উপজেলাতেই রয়েছে প্রায় ৫৬টি। এছাড়াও সদর উপজেলায় ১২টি, কাহালু উপজেলায় ১০টি, দুপচাঁচিয়া উপজেলায় ৮টি, সোনাতলা উপজেলায় ৪টি, আদমদীঘি উপজেলায় ৮টি, ধুনট উপজেলায় ১৯টি, গাবতলী উপজেলায় ৩৭টি, শিবগঞ্জ উপজেলায় ৩১টি এবং শেরপুর উপজেলায় ২৬টি। তবে জেলায় এ সংখ্যার থেকেও অধিক ইট ভাটা রয়েছে বাদি পরিবেশবাদীদের।

এর মধ্যে গত দুই বছরের মধ্যে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অভিযান চালিয়ে ৪৫টি ইট ভাটা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ওই ইট ভাটাগুলো জেলার পৌরসভা এলাকাগুলোতে স্থাপন করা হয়েছিল। উচ্ছেদ করা ইট ভাটার অধিকাংশই বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলার সুজাবাদ এলাকার।

জেলার শাজাহানপুর, শিবগঞ্জ, শেরপুর ও ধুনটসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, এ জেলার অধিকাংশ ইট ভাটা কোনো ধরনের আইন না মেনে আবাসিক এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ভাটার ধোঁয়া বিভিন্ন বৃক্ষ, ফলমূল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করছে। এ ছাড়াও এসব ইট ভাটার পাশে রয়েছে জনবসতি ও সামাজিক বনায়ন এবং স্থানীয় সড়ক। প্রতিটি ইট ভাটা ফসলি জমির মাঝখানে স্থাপন করা হয়েছে। শুধুমাত্র শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের খলিসাকান্দি ও দুরুলিয়া গ্রামেই রয়েছে আটটি ইট ভাটা। এ সমস্ত ইট ভাটার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে জনবসতি রয়েছে। এছাড়া অধিকাংশ ইট ভাটার ১ কিলোমিটারের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

শাজাহানপুর উপজেলার খলিসাকান্দি গ্রামের স্থানীয় কৃষক সাইফুল ইসলাম, হান্নান মিয়াসহ একাধিক কৃষক জানান, ইট ভাটা থেকে নির্গত গ্যাসের কারনে আমরা ফসলের আবাদ করতে পারি না। জমিতেই ফসল পুড়ে যায়। এতে আমরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যেন কিছুই করার নেই। কারণ ইট ভাটা ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই ইট ভাটা মালিকরা বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ভাটা মালিক জানান, অধিকাংশ ভাটাগুলো এক কিলোমিটারের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে ছাড়পত্র নবায়ন করা যাচ্ছে না। আইন বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয়েছে। এক সময় ১২০ফুট চিমনি বৈধ ছিলো। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনে এটি অবৈধ হয়ে গেছে।

বগুড়া জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বগুড়ার কোনো ইট ভাটাই বৈধ নয়। অবকাঠামো নির্মাণে ইটের প্রয়োজন। আমরা ইট ভাটা বন্ধ করলে দেশে নির্মাণ কাজ হবে না। এরপরেও জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে পৌরসভা এলাকার ৪৫টি ইট ভাটা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ’

তিনি আরও জানান, ‘নীতিমালা অনুযায়ী দেশের প্রায় সব ইট ভাটাই অবৈধ। ইট ভাটার আশপাশে কোন আবাদি জমি, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ থাকা যাবে না, পঞ্চাশটির বেশি গাছ থাকা যাবে না। এরকম জায়গা তো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বগুড়াতে বর্তমানে প্রায় দুই শতাধিক ইট ভাটা আছে সবগুলোই অবৈধ। ’

বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর বগুড়ার পরিচালক (উপসচিব) ও বিভাগীয় প্রধান পরিবেশ অধিদপ্তর সুফিয়া নাজিম জানান, জেলার অবৈধ ইট ভাটাগুলোর তালিকা করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। খুব শিগগরই এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও জেলা প্রশাসনকে অবৈধ ইট ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক জানান, বগুড়াতে অবৈধ ইট ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলমান আছে। ইতিমধ্যে পৌরসভা এলাকায় গড়ে ওঠা ইট ভাটাগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অবৈধ সব ইট ভাটার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২২
কেইউএ/এনএইচআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।