শহীদ মিনার আমাদের জাতীয় জীবনে অগ্রযাত্রার এক অন্যতম প্রেরণা। শহীদ মিনার প্রতিনিয়ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই সব আত্মত্যাগী ভাষা শহীদদের কথা, যারা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত করেছেন রাজপথ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনের সকল সদর্থক অর্জনে অন্তহীন প্রেরণার উৎস ও সূতিকাগার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে প্রেরণা, তা মূলত এই ভাষা আন্দোলন থেকেই। আর এই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার। সবুজ গাছ, জলাশয় ভরা মাছ আর পাখ পাখালির অভয়াশ্রম খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যের পূর্ণতা দিয়েছে এ শহীদ মিনার। ক্যাম্পাসের প্রায় মধ্যবর্তী স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনারটি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা লগ্নেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আলবেরুনি হলের (তৎকালীন প্রশাসনিক ভবন ও হল) সামনে নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ড. মফিজউদ্দিন আহমদ শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিলো ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’। আলবেরুনি হলের সামনে এখনো রয়েছে পুরানো শহীদ মিনারটি। নাম ফলকে লেখা রয়েছে— ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী বীর শহীদদের স্মৃতির স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ ফ ম কামালউদ্দিনের সময় শহীদ মিনারটি স্থানান্তর করা হয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে। তবে সেটিও খুব একটি বড় আকারে ছিলো না। ত্রিকোণ আকৃতির শহীদ মিনারটির মাঝে তিন ফুট উঁচু স্তম্ভ ছিলো। এর পর দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা একটি দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলো। তখনকার বাম সংগঠনগুলো আন্দোলনও করেছিলো পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মাণের দাবিতে। ২০০৪ সালে অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান উপাচার্য হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়নে তৎপর হন। ২০০৬ সালে লাইব্রেরির সামনে একই স্থানে একটি দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০০৮ সালে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। পরে ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের সবচেয়ে উঁচু এ শহীদ মিনারের উদ্বোধন করনে। অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা দির্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিলো একটি দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনারের। মূলত তাদের দাবির প্রেক্ষিতেই শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। ’
৭১ ফুট উঁচু এ শহীদ মিনারটি প্রতিনিয়ত নানা সংগ্রাম ও আন্দোলনের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয় এখানকার শিক্ষার্থীদের। দেশের অন্যান্য শহীদ মিনার থেকে এই শহীদ মিনারের রয়েছে গঠনগত ও তাৎপর্যগত ভিন্নতা। ১৯৫২ সালকে সকল অর্জনের ভিত্তি বিবেচনা করে এর ভিত্তি মঞ্চের ব্যাস রাখা হয়েছে ৫২ ফুট এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সম্মান জানিয়ে ভিত্তি মঞ্চ থেকে উন্মুক্ত আকাশগামী স্তম্ভ ত্রয়ের উচ্চতা রাখা হয়েছে ৭১ ফুট। দেশ বিভাগোত্তর আমাদের জাতীয় জীবনের স্বাধীনতা অভিমুখি নানা আন্দোলনে তাৎপর্য মণ্ডিত ৮টি বছর ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ কে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ভিত্তি মঞ্চে ব্যবহার করা হয়েছে ৮টি সিঁড়ি যা ধারাবহিকতার প্রতীক। ঊধ্বর্গামী স্থম্ভ তিনটি বিশেষ তিনটি তাৎপর্যমণ্ডিত বিষয়কে নির্দেশ করে। প্রথমটি বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, দ্বিতীয়টি মাটি-মানুষ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন সংগ্রাম এবং তৃতীয়টি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তি গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ স্থাপত্য কর্মের নকশা করেছেন স্থপতি রবিউল হুসাইন। শহীদ মিনার চত্বর জাবি শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যতম প্রিয় একটি আড্ডাস্থল। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও অনুষ্ঠিত হয় এখানে। এছাড়া শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ন্যায্য আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এ শহীদ মিনারটি। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় দেশের সর্বচ্চ বিদ্যা পিঠের শিক্ষক-শিক্ষার্থী শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষা করেন না।
অধিকাংশ সময় দেখা যায় জুতা পায়ে শহীদ মিনারের ওঠেন শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার জন্য অনুরোধ করে একাধিকবার শহীদ মিনারের পাশে নোটিশ বোর্ড টানানো হলেও কোন লাভ হয়নি। এমনকি প্রায় সময় শহীদ মিনারের উপর কুকুর শুয়ে থাকতেও দেখা যায়। এদিকে দির্ঘদিন সংস্কার না করায় এবং শহীদ মিনার নির্মাণে ব্যবহৃত লাল সিরামিকের ইটে ভেজাল থাকায় বেশ কিছু ইটে শেওলা জমেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিকি বলেন, শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার জন্য নোটিশের মাধ্যমে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শহীদ মিনারের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে কাজ করে চলেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১২