ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

জীবনী

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেনু: এক মহীয়সী নারীর প্রতিকৃতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২১
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেনু: এক মহীয়সী নারীর প্রতিকৃতি

(বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মদিনে জয়ীতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গমাতা’ স্মারক গ্রন্থ থেকে জীবনীটি নেয়া। এ বছর বঙ্গমাতার ৯২তম জন্মদিন।

)

ফজিলাতুন নেছা রেনু বাংলার ইতিহাসে জাতির সংগ্রামী নেতৃত্ব সৃষ্টিতে নীরবে-নেপথ্যে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের মহান স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেনু একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুর সংসারে হাল ধরেছেন, অন্যদিকে সেই তিনিই রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন নেপথ্যের মহিরুহ।  

ফজিলাতুন নেছা রেনু ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিন বছর বয়সে তিনি পিতা জহুরুল হক ও পাঁচ বছর বয়সে মাতা হোসনে আরা বেগমকে হারান। তখন তাঁর দাদা শেখ আবুল কাশেম বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেনুর চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মা সায়েরা খাতুনের স্নেহ, মায়া-মমতায় তিনি বড় হতে থাকেন। তখনকার দিনে সামাজিক অবরোধ প্রথার কারণে দশ বছরের মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারত না। তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে পারিবারিক রীতি অনুযায়ী পড়াশোনা করতেন। টুঙ্গিপাড়া গোপালগঞ্জ স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। তিনি এ সময় থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্রের বই আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। প্রবল স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। যে কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সারা জীবনের জীবন্ত ডায়েরির সঙ্গে তুলনা করেছেন।

জগতে সব মহৎ ও সফল ব্যক্তির সাফল্যে প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে নারী; এই প্রেরণা ও শক্তি, কখনো প্রকাশ পায়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অব্যক্ত থেকে যায়। গান্ধীজির নামের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে কস্তুরবাইয়ের স্থান পেয়েছে। তিনি চরকা কেটেছিলেন, স্বামীর সঙ্গে জেলে গিয়েছেন। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বারবার উচ্চারিত হয়েছে কমলা নেহরুর কথা, তাঁকেও স্বামীর সঙ্গে কারাবরণ করতে হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর কারাবাসের সময়কাল গান্ধী বা নেহরুর কারাবাসের সময়কালের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। একইভাবে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছাও বঙ্গবন্ধুর জীবনের অপরিহার্য অংশ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের এক বিরাট সময়ই কারাবাস জীবন ভোগ করেছেন। তাঁর অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনা করাসহ প্রতিটি কাজে ফজিলাতুন নেছা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।  

শেখ মুজিবপত্নী ফজিলাতুন নেছা, কখনো বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার স্ত্রী, কখনো প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, কখনো রাষ্ট্রপতির স্ত্রী- জীবনের সকল পর্যায়েই তিনি নিঃস্বার্থভাবে জীবন ও যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সংকটের সাথি হয়ে, জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে। ফজিলাতুন নেছা একজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থেকে স্বামীর প্রতিটি কর্মকাণ্ড ও চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বামীর কৃতিত্বের অংশীদারিতে অবদান রেখেছিলেন অবিস্মরণীয়ভাবে। খোঁজখবর রাখতেন প্রতিটি ব্যাপারে, কাজ করতেন নেপথ্যে থেকে। প্রচারবিমুখ এই মহীয়সী নারী কাজ করে গেছেন নীরবে-নিভৃতে। তাঁকে অনেক কষ্ট, দুর্ভোগ ও ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর মনটি ছিল সাধারণ বাঙালি মায়ের চেয়েও কোমল। অন্যায়ের বিপক্ষে অনেক ক্ষেত্রে ছিলেন স্বামীর চেয়েও কঠিন, আবার প্রয়োজনে নমনীয়। দুঃখ-ক্লেশ সহ্যের পরিমাণ ছিল ধারণাতীত। বঙ্গবন্ধু যেমন কোনো অন্যায় বা প্রলোভনের কাছে মাথানত করেননি, ঠিক তেমনি তিনিও এ ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আত্মকেন্দ্রিকতা বা আত্মসর্বস্বতা কখনো স্পর্শ করতে পারেনি এই নির্লোভ মহীয়সী নারীকে। যে কারণে তাঁর সাহচর্যে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছেন।

মানবকল্যাণে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার ছিল অপরিসীম অবদান। তিনি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও গরিব আত্মীয়স্বজনের রোগশোকে চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক সংকটে মুক্তহস্তে দান করতেন। এ ছাড়া কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে আর্থিক সাহায্য, অনাথ, এতিম ও গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সব সময়ই। দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলে বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে কারাবাস ও রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি নিজেই ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, পরিবার-পরিজনদের খোঁজখবর নেওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ পুরো দায়ভার বহন করতেন। এককথায় দলীয় কর্মীসহ আত্মীয়স্বজনের সব সুখ-দুঃখের সাথি ছিলেন তিনি। এভাবে মানবকল্যাণে তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। বঙ্গমাতার সান্নিধ্যে যিনিই এসেছেন, তাঁর হৃদয়ে সবার অলক্ষ্যে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। ছোটখাটো অবয়ব, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, তবে তা বিদেশিনীদের মতো কটা, ফুলের রেনুর মতো গায়ের রং এবং অত্যন্ত বিনয়ী নম্রতার অধিকারী এই মহীয়সী নারী ছিলেন সবার সঙ্গে আন্তরিক ও অমায়িক। ফজিলাতুন নেছা কেবল প্রেমময়ী স্ত্রী, স্বার্থ বিসর্জনকারী ত্যাগী নারীই ছিলেন না, ছিলেন একজন আদর্শ মা। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন এক বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ এবং সাহসী যোদ্ধা।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার চিন্তাচেতনায়, আদর্শ ও মূল্যবোধের স্থান ছিল সবার ওপরে। যে কারণে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন স্বামীর আদর্শ। স্বামীর সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি গড়ে তোলেন সন্তানদের। রাজনৈতিক জীবনসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি স্বামীর পাশে থাকতেন। নিজ বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে অনেক জটিল পরিস্থিতিতে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন। মনে-প্রাণে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ বাঙালি নারী। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এই নারী অসীম ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে জীবনের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন। জীবনে কোনো চাহিদা বা মোহ ছিল না তাঁর। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সর্বান্তঃকরণে সহযোগিতা করেছেন। এমনকি ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে স্বামীর যখনই অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো, তখনই পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় তিনি এনে দিতেন। মাঝেমধ্যে গহনা বিক্রি করেও সংসারের প্রয়োজন মেটাতেন। এভাবে নানা ত্যাগের মাধ্যমেই তিনি হয়েছিলেন নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন একজন বিচক্ষণ নারী।

খুব অল্প বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম দেন ফজিলাতুন নেছা। কিন্তু জন্মের সময় এই সন্তান মারা যাওয়ায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পাশে থাকতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় তাদের বড়  মেয়ে শেখ হাসিনার জন্ম হয়। এ সময়ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় দাঙ্গাবিরোধী কর্মকাণ্ড ফেলে স্ত্রীর কাছে আসতে পারেননি। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা তাতে কোনো অনুযোগ করেননি। কারণ, তাঁর চিন্তাচেতনায় লালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুরই আদর্শ। তিনি স্পষ্টই অনুধাবন করেছিলেন স্বামীর দেশসেবার কাজ তাঁর সান্নিধ্যের চেয়ে অনেক বড়। স্বভাবতই তাঁর নিকট দেশের স্বার্থের কাছে নিজের স্বার্থ কখনো স্থান পায়নি। তিনি আনন্দের সঙ্গে শিশুকন্যাকে নিয়ে দিন কাটান। আর তখন থেকে ছোট্ট এই কন্যাটিই আজীবন তাঁর সুখ-দুঃখের সাথি হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে পূরণ করে দিয়েছিলেন রেনুর মনে মা-বাবার অভাব।

বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফজিলাতুন নেছার ছিল অপরিসীম দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে ও ভাষা আন্দোলন, ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সরকারের বিরুদ্ধে ভুখা মিছিল বের করার আন্দোলন এবং ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলে তিনি কখনো ভেঙে পড়েননি অসীম মনোবলের অধিকারী ফজিলাতুন নেছা রেনু।

১৯৪৯ সালে শেখ কামাল ও ১৯৫৩ সালে শেখ জামালের জন্ম হয় টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তখন তিন সন্তানের জননী ফজিলাতুন নেছা স্বামীর কর্মকাণ্ডে পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্য টুঙ্গিপাড়া থেকে গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনের ভাড়া বাসায় ওঠেন। শেখ মুজিবুর রহমান এ বছরই ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় বন ও কৃষি দপ্তরের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। ৩ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িতে উঠে আসেন ফজিলাতুন নেছা। কিন্তু ঘর সাজানোর আগেই মন্ত্রিসভা ভেঙে গেলে তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন আর পুলিশের হয়রানির শিকার ফজিলাতুন নেছা ১৪ দিনের সরকারি নোটিশ হাতে নিয়ে বাড়ি খুঁজতে বের হন। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সবকিছুর মোকাবেলা করেন।

১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য এবং ১৫ সেপ্টেম্বর কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। এবার শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ভেঙে নতুন দল গঠন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৩০ মে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হন। বঙ্গমাতা ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই টি বোর্ডের বাড়িতে কিছুদিন বাস করেন।

১৯৫৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় শেখ রেহানার জন্ম হয়। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। এর প্রতিবাদ করায় ১১ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ হলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ফজিলাতুন নেছা রেনুকে টি বোর্ডের বাড়িটি ছাড়তে হলো। তাঁকে বারবার অনিশ্চয়তায় পড়তে হয়। এভাবেই তিনি সব মোকাবিলা করেন। ১৯৬১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া পেয়ে আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেন। এই বছরই ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটির কাজ নিজ হাতে শুরু করেন ফজিলাতুন নেছা এবং ১ অক্টোবর নিশ্চিত আশ্রয়স্থল আপন ঘরে প্রবেশ করেন। এ বাড়িতেই ১৮ অক্টোবর ১৯৬৪তে জন্ম হয় শেখ রাসেলের। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান আবার গ্রেপ্তার হন এবং ১৮ জন মুক্তি পান। ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ ও আপত্তিকর বক্তব্যদানের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হয়ে এক বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং পরে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি লাভ করেন। প্রথম থেকেই সাহসিকতার সঙ্গে এই সব প্রতিকূল ঘটনাবলির মোকাবেলা করে চরম সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন ফজিলাতুন নেছা। এ ছাড়া ১৯৫৮ সাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জনগণের পক্ষে ও সরকারবিরোধী বক্তব্যদানের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হলে তিনি নিজে মামলার কাজ ও দল পরিচালনা করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে পার্টির নির্দেশ আদান-প্রদান করে কর্মীদের মাঝে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন। হাসিমুখে অবর্ণনীয় কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করে অভূতপূর্ব ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এই মহীয়সী নারী।  

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা করে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে জনসভা করতে গিয়ে তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন। তীক্ষ্ম বুদ্ধি, মেধা ও মননের অধিকারী ফজিলাতুন নেছা এ সময় প্রতিটি ঘটনা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতেন এবং সেই সঙ্গে দিতেন বিভিন্ন পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা। কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, সূক্ষ্মভাবে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া, নিজের হাতে তাদের রান্নাবান্না করে খাওয়ানোসহ সব কাজ তিনি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করতেন। ছয় দফা যে এক দফায় পরিণত হতে পারে, তা পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ৬ দফাকে ৮ দফায় রূপান্তর করার জন্য সভা বললে সেখানে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেদিন শুধু ফজিলাতুন নেছার সাহসী হস্তক্ষেপের ফলে ৬ দফা ৮ দফা থেকে রক্ষা পায়। ৬ দফা আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কারাবন্দীদের মুক্তির জন্য সারাদেশে ৭ জুনের সফল হরতাল। তখন সব নেতা জেলে, যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁরা হরতাল সফলতার ব্যাপারে সন্দিহান। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা নিজ বাসা থেকে আত্মীয়দের বাসায় যেতেন। সেখানে থেকে বোরখা ও সাধারণ স্যান্ডেল পরে জনসংযোগ করতেন। এভাবে শেখ ফললুল হক মণিসহ ছাত্র-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সমর্থনে ফজিলাতুন নেছার হস্তক্ষেপে ৭ জুনের হরতাল সফল হয় এবং ১৯৬৯- এ অভ্যুত্থানে ৬ দফা, আওয়ামী লীগের একমাত্র দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানেই তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের এবং দৃঢ়তর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। এ ছাড়াও ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জেলখানায় থাকা অবস্থায় তাঁর প্রথম কন্যা শেখ হাসিনার বিয়ের কাজ নিজের দায়িত্বেই সমাধা করেন।

১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ গঠন করা হয়, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ফজিলাতুন নেছা এতে বিচলিত না হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। ন্যায় ও নীতির প্রতি তিনি ছিলেন অবিচল ও অটল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ (ইন্টারোগেশন) করে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়।  কিন্তু নীতির কাছে তিনি নতিস্বীকার করেননি কখনো। বরং মামলা পরিচানার জন্য বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা প্রবাসী বাঙালিদের সহযোগিতায় লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে নিয়ে আসেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন দিকনির্দেশনাকারী বিশাল ব্যক্তিত্ব, যাঁর নেতৃত্ব সমাজ গঠনে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।  

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত করার কাজে ফজিলাতুন নেছার অপরিসীম অবদান ছিল। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চক্ষুর অন্তরালে সংগঠনকে সংগঠিত করতেন, বিচক্ষণতার সঙ্গে ছাত্রদের নির্দেশ দিতেন এবং অর্থ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন। এমনকি নিজের গহনা বিক্রি করেও অর্থ জোগাতেন। বিশেষ করে মহিলাদের জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। এর ফলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন সারা দেশে ও বিদেশে বাঙালিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবে ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাওয়ালপিন্ডিতে এক গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব করে। সেখানে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ক্যান্টনমেন্টে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে প্রস্তাবিত গোলটেবিল বেঠকে উপস্থিত থাকার কথা বলা হয়।  অনেক রাজনৈতিক সহকর্মী এর পক্ষে মত দিলেও কেবল ফজিলাতুন নেছার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার কারণে বঙ্গবন্ধু এ বৈঠকে উপস্থিত থাকা থেকে বিরত থাকেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয় এবং সামরিক শাসক আইয়ুবের পতন হয়। আর শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব অভিযুক্ত ব্যক্তি একযোগে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন। এভাবে ফজিলাতুন নেছা সংগ্রামে সফলতা অর্জন করেন। ২৩ ফেব্র“য়ারি রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত সভায় ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় বিভিন্ন দল দাবি তুলেছিল ভোটের আগে ভাত চাই। তখন ফজিলাতুন নেছা আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের অধিকার পায়; কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণেও ফজিলাতুন নেছার ছিল নেপথ্য উৎসাহ ও প্রেরণা। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তির আহ্বান জানান এবং সেদিন থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত দেশের কর্তৃত্ব ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। ২৩ মার্চ ছাত্রলীগ পল্টনে জনসভার আয়োজন করে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয় এবং ওই রাতেই রেডিও ও টেলিভিশনে উক্ত গানটি পরিবেশিত হয়। বঙ্গবন্ধুর এই ধরনের বহুমুখী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি সমভাবে সহযোগিতা করেছেন। এভাবেই তিনি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে একটি অত্যন্ত সফল ও যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিলেন। ২৫ মার্চ সকাল থেকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকলে ওই দিনই ফজিলাতুন নেছার নির্দেশে বড় সন্তান শেখ কামাল বাড়ি থেকে বের হয়ে যুদ্ধে চলে যায়। শেখ রেহানা ও খালাতো বোন জেলি শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বাসায় চলে যান। আগস্ট মাসে শেখ জামালও গোপনে যুদ্ধে চলে যায়। বাংলার মুক্তির লক্ষ্যে দৃঢ়চেতা এই জননী হয়তো ক্ষণিকের জন্যও ভাবার অবকাশ পাননি যে তাঁর সন্তানেরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরবে কি ফিরবে না। কারণ, লক্ষ্য ছিল একটাই, দেশের স্বাধীনতা তথা বাঙালির স্বাধীনতা।  

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হলে সন্তানদের নিয়ে বারবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু তাতেও তিনি নিস্তার পাননি। হানাদার বাহিনী তাঁকে মগবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর একতলা বাড়িটিতে বন্দি করে রাখে। বন্দি অবস্থায় তিনি কোনো আপস করেননি। তিনি পাকিস্তান সরকারের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করেননি। এই সময় ২৭ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদের প্রথম সন্তান জয়ের জন্ম হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকেরা ওই দুর্দিনে ফজিলাতুন নেছা রেনুকে মেয়ের পাশে দাঁড়াতে দেয়নি, বরং তারা তাঁর সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করে। এভাবেই ফজিলাতুন নেছা তাঁর স্বামী, পুত্র, আত্মীয়দের কাছ থেকে দূরে বন্দি অবস্থায় দিন কাটান। ইতিমধ্যে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাবার বাড়ি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আর অক্টোবরের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর বাবা-মা ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে ডা. নুরুল ইসলামের সহায়তায় ও তত্ত্বাবধানে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যদিও ফজিলাতুন নেছাকে তাঁদের কাছে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো, মাসে মাত্র একবার। অস্ত্রসহ পাহারা দিয়ে দু-তিনবার হাসপাতালে নিয়ে যায়, তখনই ওই কেবিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো। বাসায় একজন কাজের লোক ছিল যে বাজার করতে গিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধার তথ্য নিয়ে এসে বাসায় দিত। এভাবেই ওই কেবিন হয়ে উঠেছিল খবর আদান-প্রদানের কেন্দ্র। এমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বন্দি থেকেও ফজিলাতুন নেছা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রাখেন।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বিকেল চারটায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করেন। বন্দি ফজিলাতুন নেছা ও তাঁর সন্তানেরা আনন্দে আত্মহারা, তৎক্ষণাৎ তিনি হাবিলদারকে ডেকে বললেন তোমাদের নিয়াজি সারেন্ডার করেছে, তোমরাও সারেন্ডার করো। মনের কত জোর থাকলে বন্দি অবস্থায় এমন নির্দেশ দেওয়া যায় তা উপলব্ধি করার বিষয় ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর অশোক তারা এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ১৮ নম্বর রোডের বাড়িটি ঘেরাও করে ওখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা করেন। তখন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা বাড়ির ভেতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠে হুকুম করেন ‘হাবিলদার হাতিয়ার ঢাল দো’ সেই কণ্ঠে কি যে জাদু ছিল! পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা এক এক করে হাতিয়ার ফেলে দেয় এবং আত্মসমর্পণ করে। তারপর তিনি পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পদদলিত করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন এবং নিজেই জয় বাংলা স্লোাগান দিতে শুরু করেন। এ ছিল তাঁর বিরল দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত।  

 দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন হওয়ার আনন্দে মানুষ উচ্ছ্ব্সিত, কিন্তু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে তখনো বন্দি তাই বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ গোটা দেশবাসীই বিষাদে আচ্ছন্ন। এরপর শেখ কামাল ও শেখ জামাল দেশে ফিরেছে। এ সময় ফজিলাতুন নেছা অসীম ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে দেশি-বিদেশি নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যোগাযোগ রেখেছেন। এ অবস্থায় ৮ জানুয়ারি খবর এলো, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন পৌঁছেছেন। টেলিফেনে ফজিলাতুন নেছাসহ বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা হলো। স্বামীর কণ্ঠ শুনে ফজিলাতুন নেছা আনন্দে অশ্র“ সংবরণ করতে পারেননি। একটি বিশেষ বিমানে ১০ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে লক্ষ জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ভাষণ শুনল। ফজিলাতুন নেছা রেনুও বাসায় বসে রেডিওতে এ ভাষণ শোনেন। পরে বঙ্গবন্ধু ওখান থেকে এসে রেনু ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে মিলিত হলেন। অবশেষে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ তিনি পেলেন, যে স্বপ্ন দুজনে একসঙ্গে দেখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ত্রিশ লাখ শহীদ, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দুই লক্ষাধিক মা-বোন, পঙ্গু ও আহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার, কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধবিধ্বস্ত পথঘাট, ব্রিজ, বিধ্বস্ত গ্রাম-শহর মাইনপোতা বন্দর নিয়ে দেশ গড়ার যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় ফজিলাতুন নেছা তাঁর সহযাত্রী ছিলেন। কারণ, কোনো প্রতিকূল অবস্থায়ই তাঁকে কখনো হতাশ করতে পারেনি বা তিনি থমকে যাননি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বিশেষ করে আত্মত্যাগী, লাঞ্ছিত মা-বোনকে সহযোগিতা করা, তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে গিয়ে সান্ত্বনা দেন এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন তিনি। যুদ্ধে লাঞ্ছিত অনেক মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে তাদের সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন। নতুন জীবনের সন্ধান দেন, তাদের জীবনে আলোর সন্ধান দেন, মুখে হাসি ফোটান।

ফজিলাতুন নেছা রাষ্ট্রীয় প্রটোকলসহ অন্যান্য দায়িত্বও সমভাবে অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদন করতেন। ১৯৭২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সফরকালে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোসহ সমস্ত রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেনু প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি কখনো লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ ও বিলাসিতার কথা চিন্তা করেননি। এমনকি তিনি আত্মীয়স্বজন ও সাধারণ মানুষের সংযোগ ছেড়ে গণভবনে যাননি। ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি থেকে নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুর জন্য খাবার পাঠাতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মহীয়সী নারী সর্বদা স্বামীর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে মানবকল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। দেশ ও দেশবাসীর জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জিনিসপত্রের অত্যধিক দাম, পাকিস্তানি দোসরদের অন্তর্ঘাতমূলক বিশৃঙ্খলা, সুযোগসন্ধানী লোকদের অত্যাচার-অনাচার বেড়ে যায়। কিন্তু সীমাহীন আর্থিক সংকট, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরে দেশকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে শান্তির অগ্রদূত হিসেবে বিশ্ব শান্তি পরিষদের আন্তর্জাতিক ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কার পান।

১৯৭৪ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছাকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা প্রদান করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর গণমুখী পদক্ষেপসমূহই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও দেশি-বিদেশি শোষক শ্রেণিকে আতঙ্কিত করে তোলে। আতঙ্কিত ও স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের সম্মিলিত আক্রমণেই বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিবেক-বিবেচনাহীন ও মনুষ্যত্ববর্জিত একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের হাতে প্রাণ দিতে হয় বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেনুকে। দুই পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও দশ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই নববিবাহিত পুত্রবধূ, শেখ নাসেরসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে দিতে হয়েছিল তাঁদের তাজা প্রাণ, যারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ইতিহাসের এক নিষ্ঠুরতম ঘটনার শিকার হয়ে ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও জীবন দিতে হয়েছিল। মরণেও সাথি হয়ে থাকলেন বাংলার বাস্তব স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, নজিরবিহীন ত্যাগী এই অসাধারণ মহীয়সী নারী।

অসাধারণ বুদ্ধি, সাহস, মনোবল, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেনু, যে কারণে দেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনি স্বামীকে, জনগণকে দৃঢ়চিত্তে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে প্রেরণা দিয়েছেন, উদ্দীপিত করেছেন নিজ মেধা ও মননে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে তাঁর জীবনের মহৎ কাজ ও নেপথ্যের রাজনৈতিক কর্মজীবনের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা অবশ্যই স্বীকার্য, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। বলা যায় বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ফজিলাতুন নেছা একে অপরের সম্পূরক। তাঁর জীবন পরিক্রমার দিকে তাকালে মনে হয় তিনি ছিলেন সামাজিক বিন্যাসকে সুসংহত রাখার মানুষ। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণচেতনায় নিবেদিত। তাঁর ব্যক্তিমহিমা ছিল মানুষের সঙ্গে মানবিক বন্ধনকে অটুট রাখা। এ জন্যই বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেনু এ দেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।