ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

সম্পত্তির লোভে মা-ভাইয়ের পরিকল্পনায় যুবক খুন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪১ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২১
সম্পত্তির লোভে মা-ভাইয়ের পরিকল্পনায় যুবক খুন

ঢাকা: পৈত্রিক সম্পত্তি আর মারা যাওয়া মায়ের গহনা হাতিয়ে নিতে বাড্ডার বাসিন্দা মনজিল হককে হত্যার পরিকল্পনা করে তারই সৎ ভাই ও মা। মা-ভাইয়ের সঙ্গে খোদ নিজের চাচাও এ পরিকল্পনায় যোগ দেন।

সে অনুযায়ী তিন ভাড়াটে কিলারের সহায়তায় মনজিলকে গলাকেটে খুন করা হয়। এমনকি মনজিল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় বাদী হিসেবে মামলা দায়ের করেন খুনের পরিকল্পনাকারী তার চাচা ফারুক।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের পর আত্মগোপনে চলে যান মনজিলের সৎ ভাই ইয়াসিন। কৌশলে নিখোঁজ ইয়াসিনের সন্ধান চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়।

২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডা থানার আফতাব নগরের নিজ বাসায় খুন হন মনজিল হক। এ ঘটনায় নিখোঁজ সৎ ভাই ইয়াসিনকে খুনি টার্গেট করে খুঁজতে থাকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের শেরশাহ কলোনী থেকে ইয়াসিনকে গ্রেফতারের পর জট খুলতে থাকে মনজিল হত্যা রহস্যের। জানা যায়, নিহত মনজিলের সৎ মায়ের প্রেমের প্ররোচণায় তার নিজ মাকেও এক সময় হত্যা করেছিলেন তার বাবা।

পরে ইয়াসিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একে একে গ্রেফতার করা হয় কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত ভাড়াটে খুনি রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব ও সীমান্ত হাসান তাকবীরকে।

রোববার (১৩ জুন) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডির ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।

মামলার তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডি জানায়, ৩/৪ বছর বয়সে মনজিলের বাবার সঙ্গে তার খালাতো শ্যালিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে লিপির প্ররোচণায় মনজিলের বাবা মইনুল হক ওরফে মনা শান্তিনগর বাসায় মনজিলের মা সাদিয়া পারভীন কাজলের গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যা করেন। মনজিলের মায়ের মৃত্যুর পর প্রেমিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপিকে বিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করেন বাবা মনা।

মনজিল, ইয়াসিন ও ফারুক মিয়ার ছেলে নেওয়াজের নামে শান্তিনগর বাজারের পেছনে যৌথ মালিকানার একটি ফ্ল্যাট ছিল। ওই ফ্ল্যাটে মনজিলের মা মনজিলকে নিয়ে প্রথমে বসবাস করতেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর মনজিলের বাবা মনা, মনজিল, তার সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি ও লিপির ঔরশজাত সন্তান ইয়াসিনকে নিয়ে বসবাস করতেন।

ইয়াসিনের বয়স যখন ১২/১৩ বছর তখন মনজিলের বাবা মনা ফ্ল্যাটটি গোপনে বিক্রি করে দেন। ভাই ফারুক মিয়া তার ছেলের নামের অংশের ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা চাইলে ফারুক মিয়াকে মাদকাসক্ত বলে প্রচার করে বাড্ডার একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ২ মাস ২১ দিন আটকে রাখেন।

ফারুক মিয়ার লন্ডন প্রবাসী ছেলে নেওয়াজ পরে তাকে উদ্ধার করেন। এ ব্যাপারে ফারুক মিয়া কোনো মামলা করেননি। তবে মনজিলের বাবা মনার মৃত্যুর পর সম্পত্তি বাগাতে ও আগের লাঞ্ছনার শোধ তুলতে ফারুক মিয়া তার ভাতিজা ইয়াসিন ও ভাড়াটে তিন খুনি দিয়ে মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনার করেন।

তদন্তকালে জানা যায়, মনজিল তার বাবার মৃত্যুর পর মৃত মায়ের স্বর্ণালংকার ফিরে পেতে সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপিকে চার্জ করেন। তিনি মনজিলকে জানান যে, স্বর্ণালংকার তার মামা আবু ইউসুফ নয়নের কাছে আছে। মনজিল গহনাগুলো ফেরত চাইলে ফেরত না দিলে রাজারবাগের বাসায় নয়নকে লাঞ্ছিত করেন। এরপরই মূলত শুরু হয় মনজিল হত্যার পরিকল্পনা।

ইয়াসিন তার সৎ ভাই মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে মামা নয়নের সঙ্গে পরামর্শ করলে সম্মতি দেন এবং হত্যার কাজে খরচ করার জন্য ইয়াসিনকে ২০ হাজার টাকাও দেন। এরপর খুনের পরিকল্পনা করেন ইয়াসিন।

মা লিপি, মামা আবু ইউসুফ ও মামলার বাদী চাচা ফারুক মিয়ার পরামর্শে খুনের আগের দিন ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ভাড়াটে তিন খুনি ইয়াসিন হকের বনশ্রীর পৈত্রিক ফ্ল্যাটে রাত্রি যাপন করেন। সেখানে গোপন বৈঠক হয় ও পাঁচ লাখ টাকায় খুনের চুক্তি হয়।

খুনের দিন দাঁরোয়ান ছাড়া বাসায় কেউ ছিল না। এ সুযোগে সকালে মনজিলের বাসায় ঢুকে ইয়াসিনের উপস্থিতিতে তিন ভাড়াটে কিলার মনজিলকে জিম্মি করে গলাকেটে হত্যা করেন। চাচা ফারুক মিয়া বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় মামলা করেন। পরের বছর ২৪ মার্চ মামলাটি সিআইডি তদন্তভার নেয়।

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, সিআইডির তদন্ত কার্যক্রম চলাকালে মামলার বাদী প্রথম থেকেই তদন্তে অসহযোগিতা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রভাবিত করে আসছিলেন। মনজিল হকের সৎ ভাই ইয়াসিন হক ঘটনার দিন থেকে নিখোঁজ হন। এ সংক্রান্তে ইয়াসিন হকের মামা আবু ইউসুফ নয়ন রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

নিখোঁজ ইয়াসিনের সন্ধান না পাওয়ায় মনজিল খুনের সূত্রও পাওয়া যাচ্ছিল না। অজ্ঞাতনামা খুনিরা নিখোঁজ ইয়াসিন হককে অপহরণপূর্বক খুন করে মরদেহ গুম করেছে মর্মে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সিআইডিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।

তদন্তকালে জানা যায়, নিখোঁজ ইয়াসিন হক প্রকৃত নাম গোপন করে ছদ্ম নাম ব্যবহার করে চট্টগ্রামে দৈনিক জাগরণী পত্রিকার জেলা রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন। সে সূত্র ধরে চট্টগ্রাম মহানগরের শেরশাহ কলোনী থেকে চলতি বছরের গত মার্চ ইয়াসিনকে গ্রেফতার করা হয়।

তার দেওয়া তথ্য মতে, ভাড়াটে কিলার রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব ও সীমান্ত হাসান তাকবীরকে একে একে গ্রেফতার করা হয়। তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া আলামতে থাকা ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে পরীক্ষাকালে মিলে যায়। তারা প্রত্যেকে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। খুনি ইয়াসিন হকের মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, মামা আবু ইউসুফ নয়ন ও মামলার বাদী ফারুক মিয়াকে গ্রেফতারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২১
পিএম/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।