ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রেশমপল্লিতে ধূসর হয়ে উঠেছে ঈদের বর্ণিল আনন্দ  

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩০ ঘণ্টা, মে ১১, ২০২১
রেশমপল্লিতে ধূসর হয়ে উঠেছে ঈদের বর্ণিল আনন্দ   রেশম পল্লি। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: আবহমান বাংলায় উৎসব মানেই পোশাকের ছড়াছড়ি। আর সেই উৎসব যদি হয় ঈদুল ফিতর, তাহলে তো কথায়ই নেই।

শরীরে রেশমি পোশাক তো জড়াতে হবেই। কারণ হাজারও পণ্যের ভিড়েও বাঙালি সংস্কৃতিতে রেশমের আভিজাত্য এক রত্তিও কমেনি। আর যখনই কোথাও রেশমের কথা উঠবে। তখনই মনে পড়বে উত্তরের শহর রাজশাহীর নাম।

কিন্তু এবার ঈদের চিরচেনা এই আনন্দ ও অনুভূতি একেবারেই ভিন্ন। রোগশোক আর মৃত্যুর রঙে ধূসর হয়ে উঠেছে ঈদের আনন্দ। প্রাণঘাতি করোনার থাবায় জীবন চালানোই যেখানে দায়। সেখানে ঈদ আনন্দের কথা যেন ভাবাই যায় না। ঈদের অনাবিল সুখ-স্বাচ্ছন্দের চেয়ে এখন বেঁচে থাকাটাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। সবকিছুতেই পড়েছে করোনার ছাপ। তাই ভালো নেই রাজশাহীর রেশমপল্লিও। অথচ মহামারির আগেও উৎসব-পার্বণে রেশম পণ্যে চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী।

কিন্তু করোনায় সারা দেশ তথা গোটা বিশ্বে প্রসিদ্ধ রাজশাহী সিল্কের ব্যবসা চরম মন্দা যাচ্ছে। ঈদের মৌসুমে যেখানে রাজশাহীর রেশমপল্লিতে পা রাখার জায়গা থাকতো না সেখানে এখন ক্রেতা নেই। এরই মধ্যে করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বহু কারখানা। সামান্য জনবল নিয়ে যারা কোনো রকমে টিকে আছেন, তাদের লোকসানের পাল্লা দিনদিন ভারিই হচ্ছে।  আদিপেশা ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে রেশমপল্লির ব্যবসায়ীরা হিমশিম খাচ্ছেন। এতে ঐতিহ্য বজায় থাকলেও ধুঁকছে রেশমশিল্প। কয়েকটা উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনেই ধ্বংসপ্রায়। আগে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় মৌসুমেই গোটা বছরর ব্যবসা হতো। এই দুই ঈদের আয় দিয়েই পার হয়ে যেত পুরো বছর। শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন পেতেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে রেশম শিল্প সংশ্লিষ্টার এখন চরম দুর্দিনের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাপন করছেন।

রাজশাহীর রেশমপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, শো-রুমগুলোতে এখন আর সেই চিরচেনা উপচেপড়া ভিড় নেই। কারখানাগুলোয় কাজ চলছে ধীমেতালে। নেই কোনো ঈদের আমেজ। এখানে সারা বছর রেশমের পোশাক তৈরি হলেও করোনার কারণে এবার উৎপাদনেও ভাটা পড়েছে। গত বাছরও লকডাউনের কারণে ব্যবসায় হয়নি। এবারও সেই একই পরিস্থিতি। কেবল লোকসান বাড়ছেই।

রেশমপল্লির পুরনো শ্রমিক জয়নাল হোসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, একটা সময় ছিল যখন সারা বছরই রাজশাহীর বিসিক এলাকায় থাকা রেশম কারখানাগুলো সরগরম থাকতো। কিন্তু ধীরে ধীরে নানান কারণে এখন রেশমপল্লিতে সুনসান নীরাবতা নেমে এসেছে। অব্যাহত লোকসান আর ব্যাংক ঋণ ও সুদ টানতে না পেরে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্ক হাউস দোয়েল, নর্থ বেঙ্গল, সুরভীর মত ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ছোট-বড় মিলিয়ে পঞ্চাশেরও বেশি রেশম কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর হালে শুরু হয়েছে করোনা সংকট। এই করোনার কারণে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির বলছে, শুধুমাত্র রাজশাহী মহানগরীর বিসিক এলাকায় রেশম কারখানার সংখ্যা ৭৬ থেকে ১৭-তে নেমে এসেছে। আরও অনেকগুলো এখন বন্ধের পথে।

বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, নানান কারণে এমনিতেই ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্প ধ্বংসের পথে। এরপরও কোনোভাবে এই শিল্পটিকে পৈত্রিক পেশা ও ব্যবসা হিসেবে অনেকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এই রুগ্ন শিল্পে নতুন করে বসেছে করোনার থাবা। এতে অন্যান্য শিল্পের মত রেশম শিল্পেও চরম লোকসানের মুখে পড়েছে।  

এক প্রশ্নের জবাবে রেশম শিল্প মালিক সমিতি সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, তাদের হিসেব মতে করোনায় রাজশাহীসহ গোটা দেশে রেশম শিল্পের ২শ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প দুইটি অংশে বিভক্ত। একটি হচ্ছে গুটি থেকে সুতা উৎপাদন করা। অপরটি হচ্ছে বস্ত্রখাত। আর এই বস্ত্রখাতের মাধ্যমেই রেশমজাত পোশাক তৈরি করা হয়। কিন্তু এখন গুটি থেকে সুতা উৎপাদন প্রায় বন্ধ। আর যারা রেশম পোশাক তৈরি করে তাদেরও বেচাবিক্রিও প্রায় বন্ধ। করোনা পরিস্থিতির কারণে কেবল রাজশাহীই নয় পাশের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জেও প্রায় ২৫০টি তাঁত বন্ধ। তাই এর পেশার সঙ্গে যুক্ত ১০ হাজার শ্রমিক বর্তমানে বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁত বন্ধ থাকায় তারা বেতনও পাচ্ছেন না বলেও উল্লেখ করেন বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতি সভাপতি। মহানগরীর সপুরা বিসিক এলাকায় সবচেয় বড় এবং প্রতিষ্ঠিত সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ হচ্ছে রাজশাহী সপুরা সিল্ক। রাজশাহীতে ১৯৭৯ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি সুতা ও রেশম পোশাক উৎপাদন এবং বিপণনের সঙ্গে জড়িত। নিজস্ব কারখানায় রেশম সুতা উৎপাদন করে সেই সুতা থেকে পোশাক তৈরি করে থাকেন তারা। রাজশাহী ছাড়াও ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে তাদের শো-রুম রয়েছে। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পর তাদের কারখানা ও শো-রুমও বন্ধ। সীমিত পরিসরে মার্কেট চালুর ঘোষণা আসার পর বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা শো-রুম চালু করেছেন। কিন্তু বিধিবাম ক্রেতা নেই। ফলে ঈদের সময় ঘনিয়ে এলেও  ভিড় নেই এবং আগের সেই বেচাকেনাও নেই।

প্রতিবছর বৈশাখ আর ঈদকে ঘিরে বেচাকেনা জমে। কিন্তু এবার পুরো চিত্র ভিন্ন। গত বছরও ব্যবসা হয়নি। এবছরও হচ্ছে না, বলছিলেন- রাজশাহী সপুরা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান। সাইদুর রহমান বলেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদে যা ব্যবসা হয় তা দিয়েই পুরো বছরের খরচ বের হয়ে যায়। কিন্তু গেল বছর থেকে করোনার কারণে তাদের ব্যবসা চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে। ক্রেতা নেই বিক্রিও নেই। এখন পর্যন্ত কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়নি বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।  

রাজশাহীর অপর স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘ঊষা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ’। তাদের শো-রুম রয়েছে ঢাকায়ও। প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা লুৎফর রহমান জানান একই অবস্থার কথা।

করোনা ভাইরাসের জন্য গেল পহেলা বৈশাখে বিক্রি ছিল না। ওই সময় ৫০ লাখ টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। আবার ঈদেও একই অবস্থা। আগে যেখানে ঈদের আগে দিনে লাখ টাকার কেনাবেচা হতো সেখানে এখন সব মিলিয়ে ৩০/৪০ হাজার টাকাও বিক্রি হচ্ছে না। এরপরও সুদিনের আশায় তারা রেশম শিল্পকে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানান  লুৎফর রহমান।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, মে ১১, ২০২১
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।