ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

একটি গাভী থেকে ১৩১ গরুর মালিক আমিরুল 

টিপু সুলতান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২১
একটি গাভী থেকে ১৩১ গরুর মালিক আমিরুল 

পাবনা (ঈশ্বরদী): মনের ভেতরে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ছাত্রজীবনে বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে হয় আমিরুল সরদারকে। সেসময় থেকে তিনি দুই বিঘা জমিতে বেগুন আবাদ করে সেগুলো হাটে হাটে বিক্রি করতেন।

সেখান থেকে জমানো মাত্র ১৪ হাজার ৬শ টাকা দিয়ে একটি শংকর জাতের গাভী কেনেন তিনি। সেই থেকে গরু পালনের যাত্রা শুরু তার।

২০ বছরে অভাবকে জয় করে বর্তমানে তিনি ২ কোটি টাকা মূল্যের ১৩১টি গরুর মালিক। তার খামারের নাম ‘তন্ময় ডেইরি ফার্ম। ’। গরু পালন, দুধ বিক্রি, গোবর, বায়োগ্যাস প্লান্ট, কেঁচো দিয়ে জৈবসার প্রস্তুত করে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত খামারি।  

সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পদ্মা নদী অধ্যুষিত চরাঞ্চল এলাকা, লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের বরমপুর গ্রামের তন্ময় ডেইরি ফার্ম ঘুরে এতথ্য জানা যায়।

পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের বরমপুর গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান আমিরুল সরদারের গরু পালন দেখে অনেকেই উদ্বুদ্ধ। তার পরামর্শ নিয়ে ওই গ্রামের অর্ধশতাধিক বেকার এখন স্বাবলম্বী।  

সরেজমিন গিয়ে তন্ময় ডেইরি ফার্মে দেখা যায়, প্রায় ২২ বিঘা জমির উপরে খামার গড়ে তুলেছেন আমিরুল। সারি সারি বাঁধা রয়েছে ষাঁড় ও বকনা গরু। একটি গাভী থেকে বংশবৃদ্ধি। সেই ১৯৯৪ সালে ফিজিয়ান জাতের একটি গাভী থেকেই প্রজনন সম্প্রসারণ শুরু। বর্তমানে খামারে ৬৪টি ষাঁড়, ৩২টি বকনা, ৩৫টি বাছুর সর্বমোট ১৩১টি গরু। এখানে একই জাতের গরু, অন্য কোনো জাত নেই। বর্তমানে দুধ দিচ্ছে ২০টি গাভী। প্রতিদিন ৪৫০-৫০০ লিটার দুধ হয়। গাভীর বাছুরগুলোকে যত্নে রাখা হয়েছে যেন কোনো রোগবালাই না হয়।

গরুর গোবর থেকে বায়োগ্যাস প্লান্টের মাধ্যমে বাড়তি জ্বালানি চাহিদা মেটানো হচ্ছে। কেঁচো দিয়ে তৈরি করা জৈব সার ব্যবহার হয় কৃষি জমিতে।  

এছাড়াও নিজ বাড়িতে তিনি দেশীয় জাতের ব্লাকবেঙ্গল ছাগল, মোরগ-মুরগি, কবুতর পালনও শুরু করেছেন। আরো বড় পরিসরে খামার বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমিরুল। সবকিছুই বেশ পরিপাটি।  

গরুর সফল খামারি আমিরুল সরদার তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বাংলানিউজকে বলেন, ইচ্ছে ছিল স্কুলশিক্ষক হবো। কিন্তু আব্বা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে গিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। আজ খামারের পরিধি বেড়েছে অনেক। খামারে গাভীন গরুর সংখ্যা বেশি। বর্তমানে ২০টি গাভী থেকে ৫শ লিটার দুধ বিক্রি করা হয় ২০ হাজার টাকা। খামারের বাছুরই হলো লাভের অংশ। বছর শেষে ৫০টি বাচ্চা হয় সাধারণত। বাছুর থেকে আয় হয় প্রায় ৩০ লাখ। বর্তমানে সর্বসাকুল্য তার ২ কোটি টাকার গরু রয়েছে।  

বর্তমান আগ্রহী তরুণ গরু খামারিদের উদ্দ্যেশে আমিরুল বলেন, গরুর মালিকের ভবিষ্যৎ হলো বাছুর। যে গরুর মালিক বাছুরকে দুধ খাওয়ালো না, সে সম্পূর্ণই আয় থেকে বাদ পড়লো। যে বাছুরকে গরুর দুধ খেতে দিলো, গাভী মালিকের লাভ একটু যদি কমও হয় তবুও তার ইনভেস্ট হলো। আর যদি কেউ আমার মত সফল খামারি হতে চায়, খামারের পরিসর বাড়াতে চায় অবশ্যই যে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলো- যদি দুটি করে গরু বাড়ে তাহলে দুটি করে গরুর থাকার ঘরের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। গরুর দুধের দাম কম, খাদ্যের দাম বেশি তাই খরচ কমাতে খাদ্যের জন্য একটু প্রযুক্তি নির্ভর হতেই হবে। কাঁচা ঘাসের কোনো বিকল্প নাই। খরচ সাশ্রয় হলে কৃষক লাভবান হবেন।  

ঈশ্বরদী উপজেলায় ঝালমুড়ি বিক্রেতা আলফাজ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, একটি এনজিও থেকে ৭৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে আজ গরুর সফল খামারি আমি। আমিরুল সরদারের সঙ্গে পরামর্শ করে ফিজিয়ান জাতের একটি গাভী কিনেছিলাম। বর্তমানে আমার ১৬টি বকনা গরু। ৪টি ষাঁড় বিক্রি করে আমি জমি কিনেছি। বর্তমানে ১২টা গরুর দাম ২০ লাখ টাকার বেশি।  

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার গোটা লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে এখন কম-বেশি একটি করে ছোট্ট খামার সবারই বাড়িতে রয়েছে। আমিরুলকে দেখে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আমিরুল সরদার শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন? অভাবের কারণে তা পারেননি। একমাত্র ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন। কেউ দূধ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন, আবার কারো বছর শেষে গরু বিক্রি করেও আয় হচ্ছে লাখ টাকা। কেউ পরিবারে ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ যোগাচ্ছেন। নিজের গ্রামে শতাধিক সদস্যকে উদ্বুদ্ধ করেছেন আমিরুল। হাতে কলমে যারা ট্রেনিং নিয়ে আজ স্বাবলম্বী কিছুটা।  

ঈশ্বরদী উপজেলার পদ্মা নদীর চরাঞ্চল খ্যাত লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের সফল চেয়ারম্যান (ইউপি) আনিসুর রহমান শরীফ বাংলানিউজকে জানান, বর্তমান কৃষিতে সাফল্য অর্জন করেছেন অনেকে। তাই সরকারের কাছে প্রত্যাশা লক্ষ্মীকুন্ডাতে এখন যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয়, সে পরিমাণে দুধ বিক্রির করার জায়গা নেই। যদি সরকারিভাবে এই অঞ্চলে একটি দুগ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেত। দুধ থেকে সাধারণত যে সব খাদ্য তৈরি হয় তা ক্রয় করতে এই লক্ষ্মীকুন্ডার মানুষকে আর বাইরে যেতে হবে না। দরকার সরকারের একটু স্বদিচ্ছা।  

বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২১
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।