ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

লালমনিরহাটে বিজয়ের পতাকা উড়ে ৬ ডিসেম্বর

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০২০
লালমনিরহাটে বিজয়ের পতাকা উড়ে ৬ ডিসেম্বর

লালমনিরহাট: ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভোরে পাক সেনাদের হটিয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের মানুষ। এই দিন বিজয় মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে রেলওয়ের বিহারী অধ্যুষিত এ শহর, গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র।

 

প্রবীন নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনায় জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে মুক্তিকামী মানুষ উজ্জিবিত হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ পাক সেনারা নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের বাঙালি। সারাদেশের মতোই উত্তাল হয়ে ওঠে বিহারি অধ্যুষিত রেলওয়ের শহর লালমনিরহাটের পাড়া-মহল্লা।  

২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭ মার্চ দুপুরে লালমনিরহাটের মুক্তিকামী মানুষ মিছিল নিয়ে রেলওয়ের আপইয়ার্ড কলোনি পার হওয়ার সময় পাকিস্তানিদের সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। পাকিস্তানি ইপিআর জিয়াউল হকের গুলিতে মারা যান শহীদ শাহজাহান। পাকিস্তানিদের গুলিতে প্রথম শহীদ শাহজাহানকে তার বাড়ির পাশে দাফন করা হয়। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও অসংখ্য শহীদের মরদেহের সন্ধান মেলেনি।

রাজাকার আল বদর, আল সামসের সক্রিয় দল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করে নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। মা-বোনদের সম্ভ্রমহানী করে প্রতিটি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে পাক সেনা ও রাজাকাররা।  

এ অঞ্চলের নিরস্ত্র বাঙালিদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন ও হত্যা করে তৎকালিন বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) ভবনের পিছনের ডোবায় মরদেহ ফেলে রাখে পাক সেনা ও তার দোসররা। পরবর্তিতে ডিআরএম ভবনের পেছনটা গণকবর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংরক্ষণ করা হয় ৭১ এর সেই গণকবর। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলিসহ মোমবাতি প্রজ্জলন করে জাতি আজও স্মরণ করে বীর শহীদদের।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় দেশে মোট ১১টি সেক্টরের মধ্যে লালমনিরহাট অঞ্চল ছিল ছয় নম্বর সেক্টরের অধীনে। দেশের অভ্যন্তরে থাকা একমাত্র ছয় নম্বর সেক্টরটি ছিল পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ সেক্টরের কমান্ডর ছিলেন এম খাদেমুল বাশার। তার দক্ষ নেতৃত্বে ও সাহসী পদক্ষেপে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে এ সেক্টর পরিদর্শনে আসেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর পদচারনায় আরও সাহসী হয়ে ওঠে ছয় নম্বর সেক্টরের সম্মিলিত বাহিনী।

২৮ ও ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রবল আক্রমণ চালালে ৩০ নভেম্বর হাতীবান্ধা উপজেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ৪ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার বড়বাড়ি আইরখামারে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর মারাত্মক আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। প্রবল আক্রমণের মুখে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনী বিতারিত হলেও পরদিন পুনরায় বড়বাড়ি আইরখামারে আক্রমণ চালায়। জ্বালিয়ে দেয় বেশ কিছু ঘর বাড়ি। ৫ ডিসেম্বর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতভর প্রতিরোধ গড়ে তুলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ভোরে বিকট শব্দে তিস্তা রেল সেতু উড়িয়ে দিয়ে শেষ বারের মত লালমনিরহাট ত্যাগ করে রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে পালিয়ে যায় পাক সেনারা। আর তাদের দোসর রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র জমা দেয়।

মুক্তির আনন্দে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে জেলার আমজনতা। জয় বাংলা স্লোগানে বিজয়ে মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো লালমনিরহাট জেলা। দেশের আকাশে উড়তে থাকে জাতীয় পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য এ জেলার কৃতী সন্তান শহীদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন বীর বিক্রম ও ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হক বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।  

যুদ্ধের স্মৃতিচারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরল হক বাংলানিউজকে জানান, ৪ ডিসেম্বর রাতভর যুদ্ধ করে বড়বাড়ি থেকে পাকসেনাদের বিতারিত করা হয়। কিন্তু পরদিন পুনরায় তারা রাজাকারদের আহ্বানে বাঙালির উপর আক্রমণ করলে ৫ ডিসেম্বর রাতে আবারও তুমুল  আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতভর আক্রমণে পরদিন ভোরে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। ওই দিন বেশ কিছু সহযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে পিপাসার্ত হয়ে মানুষের মলযুক্ত মাঠের পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করেন বলে জানান আরেক জন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরল হক।

ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হক বীর প্রতীক বাংলানিউজকে জানান, ১৯৭১ সালে এই দিনে মুক্তিকামী মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে পড়েন। লালমনিরহাট রেলওয়ে গণকবরসহ বেশ কয়েকটি গণকবর ও বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত অনেক গণকবরের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০২০
কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad