ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

বিজয়ের মাসেই পদ্মা সেতুর 'পদ্মা জয়’

সাজ্জাদ হোসেন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০২০
বিজয়ের মাসেই পদ্মা সেতুর 'পদ্মা জয়’ পদ্মা সেতু, ছবি: বাংলানিউজ

মুন্সিগঞ্জ: পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। আর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বসানো হয়েছিল প্রথম স্প্যান।

এরপর ধাপে ধাপে এ পর্যন্ত ৪০টি স্প্যান বসানো হয়েছে।  

সেতুর মোট পিলার ৪২টি এবং এতে স্প্যান বসবে ৪১টি। আর এখন বাকি আছে দুই স্প্যান। যা বসানো হবে এ ডিসেম্বরের ১৬ তারিখের মধ্যে। তাতে দেখা যাবে ৬ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ মূল সেতুর কাঠামো।  

কাজের অগ্রগতি কতটুকু এগিয়ে যাচ্ছে, তা নির্ভর করে থাকে স্প্যান বসানোর ওপর। আর বিজয়ের মাসে এ কাজটি সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে প্রমত্তা পদ্মা জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। শুরু থেকে নানা বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে সেতুর কাজ। আর এখন পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীদের মধ্যে বইছে আনন্দ। এরই মধ্যে ৪০তম স্প্যান বসানোয় সেতুর ৫ হাজার ৮৫০ মিটার দৃশ্যমান হয়েছে।  

সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, আমাজন নদীর পরই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরস্রোতা ও প্রমত্তা নদী পদ্মা। এ নদীর ওপরই দেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। গেল বছরের জুলাই মাসে সেতুতে সম্পন্ন হয়েছে পাইল ড্রাইভিংয়ের কাজ। এরপর পদ্মার বুকে দাঁড়াতে শুরু করে পিলার। এরপর বসানো হয় স্প্যান। এসব কাজ করতে গিয়ে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর দু’টি স্প্যান বসানো হয়ে গেলেই মূল সেতুর কাঠামো দেখা যাবে।  

প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, অনুকূল আবহাওয়া আর কারিগরি জটিলতা দেখা না দিলে এ মাসের ০৪ ডিসেম্বর বসানো হতে পারে ৪০তম স্প্যান। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের সেতুর ১১ ও ১২ নম্বর পিলারে ৪০তম স্প্যান (২-ই) বসানোর পরিকল্পনা আছে প্রকৌশলীদের। এরই মধ্যে যা মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে শতভাগ প্রস্তুত করে রাখা আছে। বর্তমানে দুই পিলারে বসানোর জন্য খুঁটিনাটি কাজগুলো চলছে। অন্যদিকে, ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ৪১তম স্প্যান (২-এফ) বসবে সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর। এমন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা।  

সূত্র জানিয়েছে, মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে বসানো স্প্যানগুলোতে রেলওয়ে স্ল্যাব ও রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। সেতুতে প্রয়োজন হবে ২ হাজার ৯২৭টি রোড স্ল্যাব। এর মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত বসানো হয়েছে ১ হাজার ২৩৯টির বেশি। রেলওয়ের জন্য প্রয়োজন হবে ২ হাজার ৯৫৯টি রেল স্ল্যাব। এ পর্যন্ত বসানো হয়েছে ১ হাজার ৮৬০টির বেশি স্ল্যাব।  

প্রকৌশলী সূত্রে জানা যায়, মাটির গঠনগত বৈচিত্র্য ও গভীরতার তারতম্যের কারণে পদ্মা সেতুর মাঝ নদী ও মাওয়া প্রান্তের পিলার নিয়ে শুরুতে বেশ জটিলতায় পড়ে এ প্রকল্প। তবে শেষতক চূড়ান্ত নকশা অনুযায়ী পিলারে স্ক্রিন গ্রাউটিং করে সমাধান মিলেছে। পিডিএ (পাইল ড্রাইভিং অ্যানালাইসিস) টেস্টে যেসব পাইল উত্তীর্ণ হতে পারে না সেগুলোর জন্য করা হয় স্ক্রিন গ্রাউটিংয়ের ব্যবস্থা। হাতে গোনা বিশ্বের কয়েকটি সেতুতে এটি ব্যবহার করা হয়েছে। নানা জটিলতা অতিক্রম করেও পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে গিয়েছে। আর এ মাসে শেষ হচ্ছে স্প্যান বসানোর কাজও।  

পদ্মা সেতুর জন্য ভিটেমাটি ত্যাগ করা জলিল হোসেন জানান, নিজেদের পৈত্রিক ভিটা ত্যাগ করে দিয়েছি পদ্মা সেতুর জন্য। অনেকেই সে সময় আমাদের ভুল বুঝিয়েছিল যে এখানে সেতু সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিল সরকারের ওপর। আর এখন পদ্মা সেতুর কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। আমরাও অনেক আনন্দিত, কেননা আমাদের ত্যাগও সফলতায় রূপ নিয়েছে।  

পদ্মাপাড়ের মানুষজন জানান, চোখের সামনেই পদ্মা সেতুর কাজ দেখেছি আমরা। একদিনের জন্যও সেতুর কাজ থেমে থাকেনি। প্রথম প্রথম অনেকেই গুজব ছড়িয়েছিল, এখানে সেতু হবে না। কিন্তু আমরা পদ্মাপাড়ের মানুষজন সাক্ষী। এখন আর দু’টি স্প্যান বসানো বাকি আছে। যা এ মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা আছে। এরপর মাওয়া প্রান্ত থেকে জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যাবে। এ অঞ্চলের মানুষ আনন্দিত। সব জায়গায় এখন পদ্মা সেতু নিয়েই আলোচনা হচ্ছে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী জানান, এ সেতু নির্মাণ করার সময় নানা বিপত্তি এসেছে। তবে, গুজব ছড়ানো হয়েছে অনেক বেশি। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের জন্য মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল। অনেকেই তা বিশ্বাসও করেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে এখানে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা একসঙ্গে কাজ করেছেন। কাজের গতি কম ছিল, কিন্তু বন্ধ হয়নি। এসব বিভ্রান্তি নিয়ে আমাদের পরিবার পরিজনও আতঙ্কে ছিল। কিন্তু সব পেছনে ফেলে এখন সেতুর কাজ সবার কাছে দৃশ্যমান।  

জানা যায়, সারাদেশে চলছিল লকডাউন। করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছিল। এসবের মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতুর কাজের গতি সচল রাখতে কাজ করে গেছেন শ্রমিকরা। এ প্রকল্পে পিলারের নকশা জটিলতা, দুই দফা পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ভাঙন, বন্যা ও করোনা পরিস্থিতিসহ বেশ কিছু বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষকে।  

সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, আমাজন নদীর চেয়েও বাংলাদেশের পদ্মা বেশি খরস্রোতা। তাই সংশ্লিষ্টরা খুব স্থিরভাবে কাজ করছেন। এটি তাড়াহুড়া করার বিষয় নয়। তবে আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। সরকার ও সেতু সংশ্লিষ্টরা সেভাবেই কাজ করছেন।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। সেতুর ওপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।