ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

তাজরীন ট্র্যাজেডি: কিশোর ছেলের রিকশার প্যাডেলে চলে মুক্তার সংসার

সাগর ফরাজী, সাভার করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২০
তাজরীন ট্র্যাজেডি: কিশোর ছেলের রিকশার প্যাডেলে চলে মুক্তার সংসার মুক্তা বানু, ছবি: বাংলানিউজ

সাভার (ঢাকা): মুক্তা বানুর স্বপ্ন ছিলো, ছেলে গোলাম রাব্বানীকে (১৩) লেখাপড়া করিয়ে বড় কোনো অফিসার বানাবেন। এ স্বপ্ন নিয়ে সেই নীলফামারি জেলা থেকে ২০০৮ সালে ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় স্বামী সন্তান নিয়ে চলে আসেন মুক্তা।

 

এখানে এসে ছেলেকে একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে ২০০৯ সালে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানায় শুরু থেকেই কাজ করতে থাকেন মুক্তা বানু। তখন সময়টি ভালোই যাচ্ছিলো তার ও তার পরিবারের।  

কিন্তু এর তিন বছরের মাথায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে মুক্তার কর্মস্থল তাজরীন ফ্যাশনে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেই আগুনে মুক্তা আর তার ছেলে গোলাম রাব্বানীর স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আহত হন মু্ক্তা। এরপর থেকেই তাদের পরিবারে নেমে আসে দুঃখ-দুর্দশা। রিকশাচালক স্বামী মশিউরের টাকায় সংসার চলে না। তাই পরিবার নিয়ে দু-মুঠো খেয়ে বাঁচার জন্য বাধ্য হয়েই কিশোর ছেলেকে রিকশা চালাতে দেন মুক্তা।  

সেদিন শুধু মুক্তা বানুর স্বপ্নই পোড়েনি, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ১১৩ পরিবারের বাবা, কারো মা, আবার কারো সন্তানের। চিরতরে হারিয়ে গেছেন তারা। আর আহত দুই শতাধিক শ্রমিক বেঁচে থাকার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন৷ 

মুক্তা বানু বর্তমানে স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে তাজরীন ফ্যাশনের পাশেই এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। স্বামী অসুস্থতার জন্য মাঝে মধ্যে রিকশা চালাতে পারেন না।  

মুক্তা বানুর ভাড়া বাসায় গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনে তাদের আন্দোলন থেকে বাসায় এসেছেন ২৪ নভেম্বর তাজরীনের সামনে ফুল দিয়ে নিহত শ্রমিকদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করবেন বলে।  

কথা বলতে চাইলে প্রথমে এ প্রতিবেদকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তা বানু বলেন, আপনারা এখানে কী করেন? আমরা আজ দেড় মাস ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে না খেয়ে মরতেছি। কোনো মিডিয়া তো আমাদের সেই আন্দোলনের কথা বলে না। আমরা মরি না বাঁচি তাতে কারো কিছু যায় আসে না।  

এসময় একটু শান্ত হলে মুক্তা বাংলানিউজকে জানান, ঘটনার দিন (২৪ নভেম্বর) তিনি তাজরীন ফ্যাশনের চতুর্থ তলায় কাজ করছিলেন। এ অবস্থায় হঠাৎ ফায়ার এলার্ম বেজে উঠলে কারখানাটির সহস্রাধিক শ্রমিক জীবন বাঁচাতে ভবন থেকে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুন লাগার বিষয়টিকে গুজব হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে বাইরে বের হওয়ার গেটে তালা দেন নিরাপত্তা কর্মীরা। এতেই প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে ভবনটির ছাদ থেকে লাফিয়ে কিংবা ভবনের পাইপ বেয়ে নিচে আসার সময় জীবন হারাতে হয় শ্রমিকদের। ভবন থেকে নিচে নেমে আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান মুক্তা। তবে কারখানার ভেতরে আটকা পড়ে পুড়ে মারা যান অনেক শ্রমিক।  

কান্না জড়িত কণ্ঠে মুক্তা বাংলানিউজকে বলেন, আল্লাহ আমাকে বাঁচাইছে। যদি সেদিন বের হতে না পারতাম, বাকিদের মত আমাকেও মরতে হতো। কত মানুষ তার নিজের লোকদের হারাইছে। মানুষ বের হওয়ার জন্য কত হাহাকার করছে। চারপাশে মানুষ পোড়া গন্ধ ছড়ায় পড়ছিলো।  

চিকিৎসার জন্য কোনো সহয়তা বা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার পায়ে, হাতে আঘাত ও বুকের ভেতর একটি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। চিকিৎসার জন্য আড়াই লাখ টাকা পেয়েছিলাম সাহায্য। তবে এরপর আর কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আমার চিকিৎসার জন্য তো অনেক টাকা গেছে। এখনো আমার ওষুধ কিনতে প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়৷ 

তিনি বলেন, স্বামী রিকশা চালিয়ে যে টাকা ইনকাম করেন, তা দিয়ে তো ওষুধই কিনতে পারি না৷ সংসার চলবে কী করে। পুরোপুরি ‍সুস্থ না হওয়ায় কোনো গার্মেন্টসে চাকরিও নিতে পারি না। চাকরি হলেও কিছুদিন কাজ করার পর বেশি কাজের চাপ নিতে পারলেই কারখানা থেকে বের করে দেয়। তাই বাধ্য হয়ে ছেলেকে রিকশা চালাইতে দিছি। কেউ কি চায়, তার ছেলে রিকশা চালাক? অনেক স্বপ্ন ছিলো ছেলেটাকে লেখাপড়া করিয়ে বড় চাকরি করাবো। কিন্তু না, সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবে না৷ 

মুক্তা বানুর ছেলে গোলাম রাব্বানীর বলে, আমি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করছি৷ আরও পড়তে চাই। কিন্তু রিকশা না চালাইলে তো সংসারে ভাত খেতে পারবে না কেউ৷ তাই বাধ্য হয়ে রিকশা চালাই৷ আমার ছোট আরও এক ভাই এক বোন আছে। আমি না পড়তে পারলে কি হবে তাদের লেখাপড়া করাবো৷ 

এ বিষয়ে গার্মেন্টস টেইলার্স ওয়ার্কার্স লীগের সাভার ও আশুলিয়ার সভাপিত শ্রমিক নেতা মো. রাকিবুল ইসলাম সোহাগ বাংলানিউজকে বলেন, তাজরীনের আহত শ্রমিক মুক্তা বানুর সংসার তার স্বামী আর ছেলে রিকশা চালিয়ে কোনো মত চালায়৷ তাজরীন পোশাক কারখানার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা যদি সঠিকভাবে ক্ষতিপূরণ ও সরকারি সহযোগিতা পেতেন, তাহলে হয়তো মুক্তার কিশোর ছেলের হাতে রিকশার প্যাডেল থাকতো না৷ আমি সরকার, বিজিএমইএ ও সব এনজিওর কাছে জোর দাবি জানাই, অবিলম্বে তাজরীনের শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা হোক।  

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তোবা গ্রুপের মালিকানাধীন তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড পোশাক কারখানাটির নিচতলার তুলার গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে মৃত্যু হয় ১১৩ জন শ্রমিকের ও আহত হন দুই শতাধিক শ্রমিক।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ