ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রাজশাহীতে কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টেনে ধরেছে পুলিশ

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২০
রাজশাহীতে কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টেনে ধরেছে পুলিশ

রাজশাহী: রাজশাহীতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে কিশোর অপরাধের ঘটনা। এলাকাভিত্তিক একাধিক গ্যাং তৈরি করে কিশোররা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও মারামারিতে জড়াচ্ছে।

কখনও তা রূপ নিচ্ছে হত্যাকাণ্ডে। তাদের দ্বারা হরহামেশাই ঘটছে ইভটিজিং, মাদক, চুরি, ছিনতাইসহ নানা গুরুতর  অপরাধ। এমনকি ধর্ষণ ঘটনায়ও জড়াচ্ছে তাদের নাম। তাই কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধীদের লাগাম টানতে এরই মধ্যে অভিযান পরিচালনা করছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পরার প্রবণতা আগে থেকে থাকলেও অতি সম্প্রতি এর পরিমাণ অনেকাংশেই বেড়েছে। কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পরার পেছনে বিভিন্ন মোবাইলসহ প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার, বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্টতা, পর্নো সাইটগুলোতে বুদ হয়ে থাকা ও অনুকরণ প্রধানত দায়ী। আর  কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে তারা আলোচনায় আসার পূর্বে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ নজরদারি না থাকায় 'গ্যাং কালচার' গড়ে উঠছে। এছাড়া সামাজিক অবক্ষয় ও পারিবারিক অনুশাসন কমে যাওয়ায় এসব কিশোর যথাযথ নৈতিক মূল্যবোধ অর্জন করছে না।  

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সম্প্রতি রাজশাহীতে কিশোর অপরাধের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মাস্তান বা রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মহানগরীজুড়েই নানা অপকর্ম করছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা সড়কে নারীদের হয়রানি করতেও ছাড়ছে না। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন মহানগরবাসী।  

এ অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মাঠে নেমেছে পুলিশ। মহানগর এলাকায় গত ৯ অক্টোবর থেকে কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি)। চলমান এ অভিযানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০০ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক কিশোর অপরাধীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের মুচলেকা নিয়ে তাদের অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।  

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ই কিশোর অপরাধের অন্যতম কারণ। এখনই তাদের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কিশোরদের অপরাধ প্রবণতার জন্য বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। দেশে অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় কিশোরদের মননেও এর প্রভাব পড়ছে। এছাড়া খেলাধুলাসহ সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের চিত্তবিনোদনের জন্য তেমন কোনো সুযোগ নেই। তাই কেবল আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নয় বরং সামাজিকভাবে শিশু-কিশোরদের পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ করে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার উদ্যোগ নিলেই এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।

জানতে চাইলে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ মুহা. হবিবুর রহমান বলেন, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় এখন কিশোরদের খেলাধুলা বা চিত্তবিনোদনের জায়গাগুলো সংকীর্ণ হয়ে আসছে। তারা খেলাধুলা করতে চাইলে মাঠসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বা পরিবেশ পাচ্ছে না। ফলে সুস্থ বিনোদনের বাইরে থাকায় তারা স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। নেটদুনিয়ায় ঘুরে নানান ধরনের নেতিবাচক কনটেন্ট ব্রাউজ করছে। বদ্ধ পরিবেশ ও স্মার্টফোন আসক্তির মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার সৃষ্টি হচ্ছে।  

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আকতার বানু বলেন, পত্র-পত্রিকায় আমরা খবর পাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা যেমন পিয়ন, ড্রাইভাররা দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। এর ফলে সমাজের মানুষের চিন্তাভাবনায় নেতিবাচক পরিবর্তন আসছে।  

মানুষ ভাবছে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। ফলে তারাও সেই পথে হাঁটছে এবং একই পন্থা অবলম্বন করছে। কিশোর অপরাধের এটাও একটা কারণ। লোভে পড়ে চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে তারা জড়িয়ে পড়ছে বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক আকতার বানু।  

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, কিশোর গ্যাং কালচার আগে ছিল না। এটা অপরাধ এবং অপরাধীদের নতুন সংস্করণ। তাই কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের কেবল আটক বা গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধনের জন্য সামাজিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। খেলাধুলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও তাদের অপরাধের জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।  

এদিকে, রাজশাহীকে কিশোর গ্যাং, বাইকার গ্যাং, মাদক ও সন্ত্রাসবাদমুক্ত রাখতে এবং সাধারণ জনগণ যাতে প্রত্যাশিত সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে থানার অফিসার ইনচার্জদের নির্দেশ প্রদান করেছেন রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক। তিনি এলাকাভিত্তিক অপরাধ পর্যালোচনা করে কিশোর গ্যাংবিরোধী অভিযান আরো বেশি জোরদার ও রাজশাহী মহনগরীতে জনগণকে সচেতন করার জন্য ঊর্ধ্বতন পুলিশ কমকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।  

রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, রাজশাহীতে কিশোর অপরাধের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। কিশোররা পড়াশোনায় মনোযোগী না হয়ে বিভন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। তাই কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি পুলিশ সচেতনতামূলক কার্যক্রমও পরিচালনা করছে। তবে এ বিষয়ে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে এবং সন্তানদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন আরএমপি কমিশনার।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২০ 
এসএস/এমকেআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।