ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রায়হান ইস্যুতে চাপা এমসি’র গণধর্ষণকাণ্ড, অধরা মদদদাতারা

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২০
রায়হান ইস্যুতে চাপা এমসি’র গণধর্ষণকাণ্ড, অধরা মদদদাতারা রায়হান

সিলেট: এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল ছিল সিলেটসহ সারাদেশ। সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ছিল এমসি’র ছাত্রাবাসের ধর্ষণকাণ্ড।

শিক্ষাঙ্গনে ন্যক্কারজনক এই ঘটনায় দেশব্যাপী আন্দোলন হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে গণধর্ষণে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরকেও। কিন্তু তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা এখনো অধরাই রয়েছেন।  

২৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে টানা দুই সপ্তাহ উত্তাল ছিল টিলাগড়। কিন্তু ১১ অক্টোবরের পর ক্ষোভ-বিক্ষোভ পয়েন্ট বদল হয়েছে। বদল হয়েছে ইস্যুও। এমসি কলেজ সংলগ্ন টিলাগড়ের উত্তাল ঢেউ এখন নগরীর কোর্ট প্রাঙ্গণ কাঁপাচ্ছে পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায়। ফলে নগরের টিলাগড় এখন নীরব-নিস্তব্ধ।

পয়েন্ট ও ইস্যু বদল হওয়া গণধর্ষণকারীদের মদদদাতা ও আপোষ মীমাংসায় জড়িতরাও খোলস পাল্টানোর ধান্ধায় ব্যতিব্যস্ত। অথচ ক’দিন আগেও গণধর্ষণের প্রতিবাদে কর্মসূচি নিয়ে সরব ছিলেন সবশ্রেণি-পেশার মানুষ। সবার ক্ষোভ-ক্রোধ আঁচড়ে পড়েছিল টিলাগড়ে। কলঙ্কমুক্ত হতে জনতার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ধর্ষকদের মদদদাতারাও!

এ বিষয়ে সিলেট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদুল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহিন বলেন, একটা অপরাধ আরেকটার কারণে চাপা পড়ুক এটা আমরাও চাই না। দু’টি ঘটনাই হেফাজতে ঘটেছে। গণধর্ষণের ঘটনা পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে এবং রায়হান হত্যার ঘটনা পুলিশ হেফাজতে ঘটেছে। এমসি’র ছাত্রাবাসের গণধর্ষণ ঘটনার সঙ্গে শাহপরান (র.) থানার ওসির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধী ও মদদদাতাদের সঙ্গে তার সখ্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর করোনাকালে কলেজ বন্ধ থাকলেও অপরাধীরা কীভাবে ছাত্রাবাসে অবস্থান করে এ কারণে হোস্টেল সুপারসহ সংশ্লিষ্টরা দায় এড়াতে পারেন না। তেমনি অপরাধী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের  রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারাও রয়েছেন। পুলিশ ও রাজনৈতিক প্রশয়দাতারা মিলে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছেন।

মদদদাতা হিসেবে তাদের সকলকে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৩০ ধারায় আসামি করে চার্জশীটে অভিযুক্ত করার দাবি জানান তিনি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সনাক) সিলেটের সমন্বয়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা দু’টি ঘটনাকে সমানভাবেই দেখছি। দু’টিরই ন্যায়বিচার হোক। কিন্তু ন্যায়বিচার নিয়ে আমরা শঙ্কিত। রায়হান হত্যার ঘটনায় দলমত নির্বিশেষে সকলেই আন্দোলনে ছিলেন। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী রায়হানের বাড়ি ঘুরে যাবার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলন থেকে পিছু হটেছেন। আমরা বলছি, এমসি কলেজের ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ, তারা বলছেন, দুর্বৃত্ত।  

তিনি আরও বলেন, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনায় মদদদাতা হিসেবে শাহপরান থানার ওসি, কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও কলেজ কর্তৃপক্ষ জড়িত। একইভাবে হেফাজতে রায়হানের মৃত্যু ও এসআই আকবরের পলায়নে পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টরা দায় এড়াতে পারেন না। এজন্য সুপারভাইজিং অথরিটি হিসেবে পুলিশ কমিশনারকেও অভিযুক্ত করা প্রয়োজন।

ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেটে রায়হানের বাড়িতে গিয়ে বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, রাজন হত্যা ও ধর্ষণের ন্যায় বিচার করার। কিন্তু রাজন হত্যাকারীদের প্রবাসীরা ধরে দিয়েছে। তাহলে কৃতিত্ব কোথায়? আর টিলাগড়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের কয়টির বিচার হয়েছে? মূলত; দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে।

গত ১১ অক্টোবর ভোররাতে কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশী নির্যাতনে রায়হান নিহত হন। পরদিন নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। ঘটনার সত্যতা পায় এসএমপির তদন্ত কমিটি। তাতে ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। ঘটনার পর সিসি ফুটেজ গায়েব করে পালিয়ে যান এসআই আকবর।

মামলাটির তদন্তভার পিবিআইয়ে কাছে হস্তান্তর করা হলে রায়হানের মরদেহ কবর থেকে তুলে পুন:ময়না তদন্ত করা হয়। নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ফাঁড়ির ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও গায়েব, তথ্য গোপন করাসহ এসআই আকবরকে পালাতে সহায়তা করার অভিযোগে ২১ অক্টোবর ফাঁড়ির টু-আইসি এসআই হাসান উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

রায়হান নগরীর একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে চিকিৎসকের সহায়ক হিসেবে চাকরি করতেন। তার মৃত্যুর ঘটনায় 'বৃহত্তর আখালিয়া (বারো হামছায়া) সংগ্রাম পরিষদ' নামে এলাকাবাসী বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে তৎপর রয়েছেন।

এর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে এক তরুণীকে গণধর্ষণ করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। পরে রাত সাড়ে ১০টায় ওই তরুণীকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে পুলিশ। মামলায় গ্রেফতার হওয়া আট আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তাদের সবাই আদালতে নিজেদের জড়িয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এমসি কলেজে গণধর্ষণকাণ্ডে যেভাবে সিলেটকে কলঙ্কিত করেছে। তেমনি বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিরপরাধ যুবকের মৃত্যু ততটা কলঙ্কিত করেছে পুলিশ প্রশাসনকে। এ ঘটনার ১১ দিনের মাথায় তোপেরমুখে পড়া সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকে সিলেট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। পুলিশ কমিশনার বদলির পর স্বস্তিতে নেই এসএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এখন অনেকেই আছেন বদলি-প্রত্যাহার আতঙ্কে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২০
এনইউ/জেআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।