ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বগুড়ায় সোনালি আঁশে স্বপ্ন ভেঙেছে কৃষকের

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০২০
বগুড়ায় সোনালি আঁশে স্বপ্ন ভেঙেছে কৃষকের সোনালি আঁশ মাথায় কৃষক। ছবি: বাংলানিউজ

বগুড়া: বগুড়ায় বিগত কয়েক বছর টানা লোকসান দিয়েছেন পাটচাষিরা। সুদিন ফেরার আশায় বার বার আবাদ তালিকায় পরিবর্তন এনেছেন।

এরপরও হার মানেননি। নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করে হাজারো কৃষক পাটচাষ অব্যাহত রেখেছেন।

বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) বগুড়া জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, পাট নিয়ে কৃষকদের নানান কর্মব্যস্ততা। সেই সঙ্গে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২টি উপজেলায় ১২ হাজার ২শ’ ১৫ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে অর্জন হয়েছে মোট ৭ হাজার ৪শ’ ৭৩ দশমিক ৭ হেক্টর জমির পাট।

কয়েক দফা বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে এ বছর বগুড়া জেলার চাষিরা বিগত বছরগুলোর তুলনায় পরিমাণে অনেক কম জমিতে পাট লাগাতে পেরেছেন। এর মধ্যে বন্যার পানিতে ক্ষতির মুখে পরতে হয়েছে চাষিদের। জেলার যমুনা অধ্যুষিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় পাট চাষ করা হয়েছে বেশি। এছাড়াও জেলার ৯টি উপজেলায় কমবেশি পাট চাষ করা হয়েছে।

এ জেলার চাষিরা এখন পর্যন্ত তুলনামূলক পাটের ভালো দাম পেলেও ফসল বিনষ্ট হওয়ায় মুখভার তাদের। এর মধ্যে জেলার বিভিন্ন বাজারে পাটের আমদানি বেশি হওয়ায় গেলো এক সপ্তাহের ব্যবধানে জাতভেদে মণ প্রতি পাটের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কমেছে।

...সরেজমিনে দেখা যায়, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই জেলার পাট চাষিরা তাদের কর্মব্যস্ততা চালিয়ে যাচ্ছেন। পানির মধ্যে কাজ করলেও শরীর থেকে ঝরছে ঘাম। তাদের সেদিকে খেয়াল নেই একদমি। পাটখড়ি থেকে সোনালি আঁশ আলাদা করতে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন কয়েকজন চাষি। জাগ দেওয়া পাট বৈঠার নিচে ফেলে পিটিয়ে হাতের কৌশলে পাটখড়ি ও আঁশ আলাদা করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তারা। সেই পাটখড়ি ও আঁশ পানির কিনারা ঘেঁষে কিছুটা ওপরের দিকে আলাদা করে রাখছিলেন।

এরপর আঁশগুলো নিয়ে শুকানোর জন্য সারিবদ্ধভাবে নেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। একইভাবে পাটখড়ি বিশেষ কায়দায় খাড়া করে শুকানো হচ্ছিল। এ কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও দেখা মেলে। এভাবে কৃষাণ-কৃষাণী মিলেমিশে সোনালি স্বপ্ন ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা।

কঠোর পরিশ্রমের পরেও তাদের চোখে-মুখে চরম হতাশার ছাপ। বন্যায় যমুনা কেড়ে নিয়েছে জমির ফসল। এরপর যার যা-ও আছে বাজারে ভালো দামের অপেক্ষায় রয়েছে। চাহিদার থেকে কম দামে পাট ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন সোনালি আঁশ ফলানো কৃষকেরা।

এবারের বন্যায় তুলনামূলক ক্ষয়ক্ষতির তালিকার শীর্ষে রয়েছেন পাটচাষিরা। তা মোটামুটি কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান দেখলেও অনুমেয়। কয়েক দফা বন্যায় ফসলের ক্ষতির পরেও কমদামে পাট বিক্রির কথা জানা গেলো বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে। পাটের কম দামের ব্যাপারটি কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন।

সারিয়াকান্দি উপজেলার আব্দুল মোকতালিব, এখলাস মিয়া, এমদাদুলসহ কয়েকজন পাটচাষি বাংলানিউজকে জানান, চরের বালিযুক্ত মাটিতে অন্য ফসল ভালো হয় না। তারা চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকার বেশিরভাগ জমিতে পাট চাষ করেন। জমিভেদে পাটচাষে ব্যয় নির্নয় হয়ে থাকে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিবিঘা পাটের জমির বিপরীতে সর্বোচ্চ ১২ থেকে সাড়ে ১৩ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়। গেল সপ্তাহে উৎপাদিত দেশি ও তোষা পাট ১৮০০-২২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আমদানি বেশি হওয়ায় সেই পাট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৭০০-২১০০ টাকা দরে।

তারা বলেন, পাটের ক্রেতা নির্দিষ্ট। অন্য ফসল যেমন অনেক শ্রেণীর ক্রেতা সাধারণ কিনে থাকেন। পাটের ক্ষেত্রে তেমন ক্রেতা নেই। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা জীবিকার তাগিদে পাট বিক্রি করতেও বাধ্য। হয়তো পাটের ক্রেতারা এ সুযোগটা নিচ্ছেন। এ জন্য চাষিরা পাটের দাম ভালো পাচ্ছেন না।

...সোনাতলা উপজেলার এজাজ উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, এবার প্রায় সাত বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। কয়েক দফা বন্যায় তলিয়ে গেছে প্রায় চার বিঘা জমির পাট। ঘরে তুলতে পেরেছেন মাত্র তিন বিঘার ফসল। প্রতিবিঘায় তার খরচ পড়েছে প্রায় ১৩ হাজার টাকার মতো। বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে ১০-১২ মণ হারে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী সেই পাট ২১০০ টাকা মণ বিক্রি করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই তার মতো জমির পাট ঘরে তুলতে পারেননি। বাজারে সর্বোচ্চ ভালো মানের প্রতিমণ ২২০০ টাকা আর ক্রেতার চোখে একটু সমস্যা মনে হলেই প্রতিমণ একই পাট ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকার মধ্যে দাম হাঁকছেন পাইকাররা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বগুড়ায় যমুনা ও বাঙ্গালি নদীতে কয়েক দফা বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে এ বছর পাট চাষিরা বিপাকে পড়েছে। জেলায় এবার পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৪১৫ হেক্টর জমি। সে অনুযায়ী, ১২ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতি সাধনের পর অর্জন হয়েছে ৭ হাজার ৪৭৩ দশমিক ৭ হেক্টর জমির পাট। এর মধ্যে বেশির ভাগ পাট চাষ করা হয় যমুনা বেষ্টিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায়।

তিনি বলেন, নদীর তীরবর্তী ও চর এলাকায় উৎপাদিত পাটের মান অত্যন্ত ভালো হয়। এ জেলায় পাট চাষের লক্ষমাত্রা বেশি নির্ণয় করা হলেও ক্ষতির কারণে পূর্ণ অর্জন হয় না। সেদিক থেকে কৃষকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ি দামটাও পায় না। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা জীবিকার তাগিদে পাট কম দামে বিক্রি করতেও বাধ্য হয়।

তিনি আরও বলেন, গেল সপ্তাহে প্রতিমণ দেশি ও তোষা পাট ১৮০০-২২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আমদানি বেশি হওয়ায় সেই পাট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৭০০-২১০০ টাকা দরে।  

তবে ব্যবসায়ীদের কাছে চরে উৎপাদিত পাটের বাড়তি চাহিদা থাকায় এখনো ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০২০
কেইউএ/এমএমএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।