ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

কৃষকের লাভ নেই, চাপ দিতে হবে ব্যবসায়ীদের ওপর

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২০
কৃষকের লাভ নেই, চাপ দিতে হবে ব্যবসায়ীদের ওপর রাজেকুজ্জামান রতন ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

ঢাকা: দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে আলু। এজন্য সরকার কয়েকদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো তিন পর্যায়ে (হিমাগার, পাইকারি ও খুচরা) আলুর দাম বেঁধে দিলেও অস্থির আলুর বাজার।

কেউ মানছে না নির্ধারিত দাম।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় এখনও খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি আলু ১৫-২০ টাকা ও হিমাগারে ৭ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রশাসনের অভিযানের মুখে অনেক বিক্রেতা আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন।

সরকারের হিসাব বলছে, গত মৌসুমে দেশে প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় আলু ঘাটতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্যবসায়ী আর মধ্যসত্ত্বাভোগীদের কারণেই আলুর দাম বেড়েছে। দাম বেঁধে দিলেও কৃষকের কোনো লাভ নেই।

বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আলুর দাম বেঁধে দিয়ে কিছু হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাজারে আলু আনতে নির্ধারিত দাম উঠিয়ে দিয়ে কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও ব্যাপারীদের সঙ্গে বসতে হবে। তাদের ওপর চাপ দিয়ে আলু বাজারে আনতে হবে। একই সঙ্গে মধ্যসত্ত্বাভোগীদের নজরদারিতে এনে ঘাটতি মেটাতে প্রয়োজনে আমদানি করতে হবে।  

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সিনিয়র গবেষক ও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, “বাংলাদেশে আলু ভোক্তা পর্যায়ে আসতে অনেক হাত বদল হয়। ফলে দাম বেড়ে যায়। যারা উচ্চ মূল্যে আলু কিনেছেন তারা বাজারে ছাড়তে চাইবেন না। তাই সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম দিয়ে এদের বাজারমুখো করা কষ্টকর হবে। ”

তিনি বলেন, “এ বছর আমাদের আলুর কিছুটা ঘাটতি আছে। করোনা ও বন্যার জন্য অন্যান্য সবজির উৎপাদন কম হওয়ায় আলুর ব্যবহার বেশি হয়েছে। ঘাটতি মেটাতে সুযোগ থাকলে ভারত থেকে কিছু পরিমাণ আলু আমদানিও হতে পারে। ”

তিনি বলেন, “কেউ যেন মজুদ করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকলে সরবরাহ বাড়বে, দাম বাড়বে না। ”

তবে এ বছর বাজারে নতুন আলু এলেও পুরনো আলুর দাম কমবে না বলে মনে করেন তিনি।  

ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ ও প্রফেসর ড. হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে বলেন, “যে কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণ হয় সাধারণত সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। আলুর দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। এখানে মধ্যসত্ত্বাভোগীরা এ কাজটি করেছে। তাদেরকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। ”

তিনি বলেন, “সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিল এটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এখন সর্বোচ্চ ৩০ টাকা হলে ভালো হতো। সরকার অ্যাকশনে গিয়েও ফিরে এসেছে। কারণ ব্যবসা আর রাজনীতি এক হয়ে গেছে। ”

কৃষক সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সবুর আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের দেশের বড় সমস্যা উৎপাদক শ্রেণী বা কৃষক কখনো দাম পায় না। ব্যবসায়ীরা আলুর কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। কারণ বাজার ও ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ”

তিনি বলেন, “যদি বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকতো, তাহলের আলুর দাম ২০ থেকে ২৫ টাকার বেশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার যে দামই বেঁধে দিক না কেন কৃষকের কোনো লাভ নেই। বরং এখন কৃষক উচ্চমূল্য দিয়ে আলু কিনে খাচ্ছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম ভোক্তার জন্য সুখকর নয়। সরকার সুবিধা দিয়েছে কোল্ড স্টোরেজ, মধ্যসত্ত্বাভোগী ও ব্যবসায়ীদের। ”

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন বাংলানিউজকে বলেন, “আলুর বাজার হঠাৎ করে অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার পেছনে সিন্ডিকেটের একটি কৌশলী হাত ছিল। সরকার প্রথমে যে দাম নির্ধারণ করলো, তা ব্যবসায়ীদের কৌশলের কারণে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ঝুঝে গেছে সরকারের সিদ্ধান্তের কোনো স্থিরতা নেই, একটু চাপ দিলে সরকারকে বিপদে ফেলা যায়। ফলে এটা ব্যবসায়ীদের আরও বেশি সু্বিধা করে দেবে। ”

তিনি বলেন, “কৃষকরা দাম পায় না। অথচ মধ্যসত্ত্বাভোগীরা লাভ করে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ব্যবসায়ী বান্ধব রাজনীতির কারণে। ”

দেশে আলুর কোনো ঘাটতি নেই দাবি করে তিনি বলেন, “শুধু বাজার ব্যবস্থাপনার কারসাজিতে ভোক্তাদের পকেট থেকে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা চলে গেল। একমাস তারা এভাবে রাখতে পারলে আরও ১২শ’ কোটি টাকা লাভ করতে পারে। এমন সুযোগ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। ”

এদিকে মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির নির্দেশে বুধবার থেকে ২৫ টাকা দরে আলু বিক্রি শুরু করেছে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।  

হঠাৎ আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম সর্বোচ্চ ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রায় ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি করছেন না ব্যবসায়ীরা।  

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৯ লাখ মেট্রিক টন আলু হয়েছে। দেশে আলুর চাহিদা ৭০ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসেবে উদ্বৃত্ত আলুর পরিমাণ প্রায় ৩৯ লাখ মেট্রিক টন। তবে সরকারি এই তথ্যের বিপরীতে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তারা বলেন, ২০১৯-২০ মৌসুমে ৯০ লাখ মেট্রিক টন আলু হয়েছে। দেশে বছরে আলুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বীজ আলু দরকার প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন। সংরক্ষণ পর্যায়ে কিছু নষ্ট ও অপচয় হয়। এ ছাড়া বিদেশে রপ্তানিও হয় কিছু আলু।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২০
জিসিজি/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।