ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘পাত্র চাই’ প্রতারক চক্র: স্বামীর সহযোগিতায় সাদিয়ার প্রতারণা

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২০
‘পাত্র চাই’ প্রতারক চক্র: স্বামীর সহযোগিতায় সাদিয়ার প্রতারণা প্রতারক সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস

ঢাকা: গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা, মাথায় হালকা সোনালি বর্ণের চুল। পরনের পোশাক সম্পূর্ণ আধুনিক।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান সিটিজেন। ভালো বাংলা বলতে না পাড়ায় সঙ্গে একজন ট্রান্সলেটর (দোভাষী) রাখতেন সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৮)। যদিও এসএসসির গণ্ডি পার হতে পারেননি তিনি।

শত শত কোটি টাকার বিজনেস দেখাশোনার জন্য ‘কানাডার সিটিজেন ডিভোর্সি পাত্রীর জন্য বয়স্ক পাত্র চাই’ জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছিলেন। শতাধিক পাত্রের সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্টে দেখাও করেন তিনি। এরপর কানাডায় নিয়ে প্রলোভন দিয়ে পাসপোর্ট, ভিসা তৈরি এবং কানাডায় থাকা তার সম্পূর্ণ ব্যবসার অর্থ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে ছলচাতুরি করে কোটিপতি বনে যাওয়া এই সাদিয়া জান্নাতুল আসলে একটি প্রতারক চক্রের মূলহোতা।

গত ১১ বছরে শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে ৩০ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক সাদিয়া। আর ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০ কোটি টাকার সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সাদিয়ার প্রতারণামূলক সব কাজে সহায়তা করতেন তার দ্বিতীয় স্বামী মুহাম্মদ এনামুল হাসান ওরফে জিহাদ। এছাড়াও চক্রের আরও এক নারীসহ চার ব্যক্তি জড়িত রয়েছে।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে গুলশানে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের মূলহোতা সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌসকে গ্রেফতারের পর প্রতারিত হওয়া অর্ধশতাধিক ভুক্তভোগী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। এরপর গত ৯ অক্টোবর রাতে এক অভিযানে চক্রের অপর সদস্য মো. ফিরোজকে গ্রেফতার করা হয়। সে এ চক্রের মূলহোতা সাদিয়ার গাড়িচালক ছিলেন। এছাড়াও ফিরোজ চক্রের অফিস ম্যানেজমেন্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তবে এ চক্রের অন্যতম সদস্য সাদিয়ার স্বামী এনামুল হাসান ওরফে জিহাদ এখনও পলাতক।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্রেফতারের পর রিমান্ডে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের মূলহোতা সাদিয়া ও তার গাড়িচালক ফিরোজ জানান, সাদিয়া কুমিল্লার দেবিদ্বার গ্রামের এবং জিহাদ বরিশালের মুলাদীর বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা। সাদিয়া ও এনামুলের প্রথমে ফেসবুকে পরিচয় হয়। আলাপচারিতায় ঘনিষ্ঠ হলে তারা বিয়ে করেন। এরপর দু’জনে মিলে একটি প্রতারক চক্র গড়ে তোলেন। চক্রে পাত্রী সাজতেন সাদিয়া। এছাড়াও আরও এক নারী পাত্রী সাজতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে একজন মামা, ম্যানেজার, কাজী, একজন ট্রান্সলেটর (দোভাষী) থাকতেন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে এ পর‌্যন্ত চক্রের মুলহোতা ও তার গাড়ি চালককে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। তার রিমান্ডে অনেক তথ্য দিয়েছে। এ চক্রে সাদিয়ার স্বামীও জড়িত। আমরা জড়িত বাকি সদস্যদের নাম পেয়েছি। চক্রের সব সদস্যকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতারক সাদিয়ার কাছ থেকে একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে। প্রতারণা করে কার কাছ থেকে কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এবং ভুক্তভোগীদের নাম-পরিচয়, মোবাইল ফোন নম্বর লিখে রাখতেন ওই ডায়েরিতে। আবার তারা কিছু মানুষকে টার্গেট করতেন। তবে একজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে একটি সিম দিয়েই কথা বলতেন। তার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর ওই মোবাইল ফোন ও সিম নম্বর সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতেন।

ভুক্তভোগী মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বিবাহিত দুই সন্তানের বাবা। এরপরও তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে সাদিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাদিয়া তাকে দেখে পছন্দ করার পর ভুক্তভোগীর পাসপোর্ট নিয়ে নেন। খরচ বাবদ দুই লাখ টাকা নিয়ে কিছুদিন পর কানাডার ভুয়া ভিসা দেন। এরপর বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে তার কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

ভুক্তভোগী মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেখা করার পর প্রতারক সাদিয়া কম কথা বলেন, তবে তিনি যেই কথাগুলো বলতেন, সেগুলো খুব সুন্দর কথা ছিল। আমি বিবাহিত এবং দু’টি সন্তান রয়েছে জেনেও তিনি আমাকে শর্ত দিয়েছিলেন যে, তোমাকে আমি বিয়ে করে কানাডায় নিয়ে যাবো, কিন্তু কখনও তোমার স্ত্রী ও সন্তানদের ছাড়তে পারবে না। কিন্তু সুন্দর কথা বলে আমার সব টাকা হাতিয়ে নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এ প্রতারক। ’

শেরপুরের নকলা থানায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার মোক্তার হোসেন। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন। তিনিও প্রতারণার শিকার হন। তরে তার ঘটনাটি ছিল একটু ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘আমার বড় ছেলে কানাডায় যেতে খুব আগ্রহী ছিল। আমরা কোনো স্কোপ পাচ্ছিলাম না। তাই এ বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করি। আমাদের ধারণা ছিলো এ স্কোপের মাধ্যমে আমরা কানাডায় চলে যেতে পারবো। সপরিবার কানাডা পাঠানোর কথা ছিল। প্রতারক জান্নাতুল জানায়, সপরিবার কানাডায় যেতে হলে মাথা পিছু ৫ লাখ টাকা করে মোট ৩০ লাখ টাকা লাগবে। ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন সময় তাদের ১৬ লাখ টাকা দিয়েছি। তবে সব টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়েছিল ওরা। এরপর হঠাৎ তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্লক, মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ। গুলশানের ডিপ্লোম্যাটিক জোনে যে বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিল, সেটিও ভুয়া। গ্রামের ঠিকানাও ভুয়া। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২০
এসজেএ/এফএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।