ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

শিল্পপতি-জেলা পরিষদ কর্মকর্তাদের নামে ৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা  

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০
শিল্পপতি-জেলা পরিষদ কর্মকর্তাদের নামে ৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা
  জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান (বাঁয়ে), পাশের জমিটি অবৈধভাবে লিজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জেলা পরিষদের বিরুদ্ধে

কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ায় ব্যক্তি মালিকানাধীন মার্কেট ভেঙে দখলের অভিযোগে জেলা পরিষদের পাঁচ কর্মকর্তা এবং এক শিল্পপতির বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে ভুক্তভোগী একটি পরিবার।  

অপরদিকে, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি রবিউল ইসলামের অবৈধভাবে দখল করা সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি দখলমুক্ত করতে নোটিশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতর।

সেই সঙ্গে জেলা প্রশাসনের ১৫ একর জমিও তার থেকে দখলমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

ক্ষতিপূরণের অভিযোগটি রোববার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে কুষ্টিয়া যুগ্ম-জেলা জজ আদালতের বিচারক রাখিবুল ইসলামের আদালতে দাখিল করা হলে আরজিটি আমলে নিয়ে মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহতাব উদ্দিন। মামলা নম্বর- ৫৭/২০২০।  

মামলার আসামিরা হলেন- কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান, সহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, সার্ভেয়ার মো. মনিরুজ্জামান, প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহিনুজ্জামান শাহীন এবং দখলকৃত জমিতে স্থাপনা গড়ে তোলা শিল্পপতি কেএনবি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১০ জুন বিকেল ৪টার দিকে সদর উপজেলার কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশের বটতৈল এলাকার রাকিবুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির মালিকানা সত্ত্ব দখলীয় ও রেকর্ডভুক্ত জমিতে নির্মিত ২২টি দোকান বিশিষ্ট ‘প্রামাণিক মার্কেট’ নামের দ্বি-তল ভবনটি ভেঙে দিয়ে জবর দখল করেন কেএনবি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামক একটি পোল্ট্রি, মৎস্য ও পশুখাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানার মালিক কামরুজ্জামান। তার দাবি, জমিটি কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ থেকে ইজারা সূত্রে তিনি পেয়েছেন। যদিও বটতৈল মৌজার খতিয়ান নম্বর আর এস ৯৫৮ দাগ নম্বর ২০২৮ এর জমির মালিকানা সংক্রান্তে জেলা পরিষদের দাবির কোনো ভিত্তি নেই বলে নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা।

এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত রাকিবুল ইসলাম বাদী হয়ে আড়াই কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের দাবি করে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ আরও তিন কর্মকর্তা ও শিল্পপতি কামরুজ্জামান ছাড়াও ১২-১৫ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০(খ)/১৪৩/৪৪৭/৪৪৮/৪০৩/১০৯ ও ৪২৭ ধারায় অভিযোগ এনে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা করতে যান।
কিন্তু পুলিশ থানায় মামলা না নেওয়ায় অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক রেজাউল করীমের আদালতে মামলা করেন। মামলা নম্বর সি আর-৫৯৭/২০১৯।

অভিযোগ আমলে নিয়ে আদালত ঘটনার তদন্তসহ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন কুষ্টিয়া পুলিশ সুপারকে। যদিও আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে চূড়ান্ত মন্তব্যে বিবাদীদের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশকে পক্ষপাত দুষ্ট বলে অভিযোগ এনে নারাজি দাখিল করেন বাদীর আইনজীবী। আদালতও নারাজি আবেদনটিকে যৌক্তিক বিবেচনায় আমলে নেন।

প্রকাশ্য দিবালোকে প্রভাবশালী মহল কর্তৃক মার্কেট ভেঙে তা জবর দখল করার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হন ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের জিএম (কারখানা) রাকিবুল ইসলাম। এ নিয়ে মানসিক চাপের কারণে মামলাটি চলমান অবস্থায় গত ৭ ফেব্রুয়ারি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পরে বাদীর ওয়ারিশ মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে এ মামলাটি করেন আদালতে।

রাকিবুল ইসলামের ওয়ারিশরা (মা রোকেয়া খাতুন, স্ত্রী হোসনেয়ারা খাতুন, ছেলে হুসাইনুল ও হুজ্জাতুল ইসলাম) এ মামলার বাদী।  

বাদীরা ক্ষতিপূরণ দাবির তফসিলে উল্লেখ করেছেন যে যথাক্রমে- নয় শতাংশ জমিতে থাকা তাদের চারতলা ভিত্তি সম্পন্ন দোতলা ভবনে ২২টি দোকান ছিল। দোকানগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এসব দোকানের মালপত্র লুটপাট করা হয়। যার আর্থিক মূল্য দুই কোটি ৭০ লাখ টাকা, গত বছরের জুন মাস থেকে এ পর্যন্ত ১৫ মাসের দোকান ভাড়া (প্রতিমাসে এক লাখ ২০ হাজার টাকা হিসেবে) ১৮ লাখ টাকা, এসব ঘটনায় মানসিক বিপর্যয়ের মুখে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রাকিবুল ইসলামের মৃত্যুজনিত ক্ষতি বাবদ দুই কোটি টাকাসহ উচ্চ ও নিম্ন আদালতে মামলা পরিচালনার সমুদয় খরচ হয়েছে। মামলার বিবাদীরা পরস্পর যোগসাজশে ১২০(খ)/১৪৩/৪৪৭/৪৪৮/৪০৩/১৭৯ ও ৪২৭ ধারায় অপরাধ সংঘটিত করায় এ ক্ষতিপূরণের দায় তাদের ওপর বর্তাবে বলে জানালেন বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহতাব উদ্দিন।  

এ বিষয়ে শিল্পপতি কামরুজ্জামান বলেন, জমিটি আমাকে জেলা পরিষদ লিজ দিয়েছে। মামলা হয়ে থাকলে আমি আইনগতভাবেই তা মোকাবিলা করব।

কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

তবে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী বিবাদী শফিকুল আজম বলেন, দেখুন আমি এখানে চাকরি করি। আমার ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নয়। যা কিছু হয়েছে সব চেয়ারম্যান স্যার এবং প্রধান নির্বাহীর হুকুমে আমি দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। মামলা হয়েছে এটাও তারাই দেখবেন।

সরকারি কাজ করতে গিয়ে যদি মামলা হয়, তাহলে সেটা সরকারই দেখবে বলে জানালেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহিনুজ্জামান।

এদিকে সাম্প্রতি এনআইডি জালিয়াতি করে কুষ্টিয়া শহরের একটি মূল্যবান জমি বিক্রির ঘটনার পর থেকে বেশ নড়ে চড়ে বসেছে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন।
এরই মধ্যে এ ঘটনায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউলে নাম উঠে এসেছে।  
রবিউলের দখলে থাকা বেশ কয়েকটি জমি উদ্ধারে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে লাহিনী এলাকায় সড়ক ও জনপথের প্রায় পাঁচ শতাংশ জমি এবং গড়াই নদীর তীরে জেলা প্রশাসনের ১৫ একর জমি তিনি জবর দখল করে ভোগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সড়ক ও জনপথ থেকে আগামী ১০ দিনের মধ্যে দখল করা জমি থেকে প্রাচীরসহ অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে নিতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন থেকেও দখল করা জমি থেকে স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে।


জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বড় বাজার এলাকায় গড়াই নদীর তীরে জেলা প্রশাসনের অধীনে থাকা ১৫ একর জমি জেলা পরিষদ দখল করে কোনো অনুমতি না নিয়ে পার্ক নির্মাণ করছে। বিগত পাঁচ বছর ধরে চলে আসছে পার্কের কাজ। দখল করা নদীর জায়গায় সরকারি অর্থে পার্কের বেশ কিছু কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।

সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তানিমুল ইসলাম জানান, অবৈধভাবে সড়কের জায়গা দখল করে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে রোববার (২০ সেপ্টেম্বর) সেখানে লাল কালি দিয়ে মার্ক করে দেওয়া হয়েছে। রবিউল ইসলামের কাছে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে নিজ দায়িত্বে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে ফেলার জন্য। তা না হলে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ভেঙে ফেলা হবে।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের হোসেন চৌধুরী জানান, পার্কের পুরো ৪৫ বিঘা জায়গাই গড়াই নদীর। জেলা প্রশাসন থেকে জেলা পরিষদ কোনো রকম বন্দোবস্ত নিয়েই অবৈধভাবে পার্ক নির্মাণ করছে। এজন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থাপনা ভেঙে ফেলা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ