ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আম্পানের ৪ মাস: শ্রীউলায় মানবিক বিপর্যয়

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
আম্পানের ৪ মাস: শ্রীউলায় মানবিক বিপর্যয়

শ্রীউলা (আশাশুনি, সাতক্ষীরা) থেকে ফিরে: ঘূর্ণিঝড় আম্পানের দুই মাস ২১ দিন আগে মারা যান সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক। তাকে দাফন করা হয়েছিল পারিবারিক কবরস্থানেই।

কিন্তু ২০ মে রাতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে খোলপেটুয়া নদীর পাঁচটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এতে নদীতে বিলীন হয়ে যায় হাজরাখালীর আব্দুল মান্নানদের পারিবারিক কবরস্থান। কবর থেকে পানিতে ভেসে ওঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেকের মরদেহ। পরবর্তীকালে তাকে অন্য গ্রামে নিয়ে আবারও দাফন করা হয়।

শুধু কবরস্থানেই সীমাবদ্ধ নয়, আম্পানের পর চার মাস অতিবাহিত হলেও ভাঙনকবলিত বেড়িবাঁধ ঠিক না করায় প্রতিদিনের জোয়ার ভাটায় পাকা ভবনসহ হাজরাখালীর দেড় শতাধিক পরিবারের ভিটে মাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ধসে পড়েছে শ্রীউলা ইউনিয়নের চার হাজারেরও বেশি কাঁচা ঘর-বাড়ি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার অপেক্ষায় ধুকছে আরও কয়েক হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি। জোয়ারের পানির প্রবল স্রোতে হাজরাখালী, মাড়িয়ালা, কলিমাখালী, কোলা, ঘোলাসহ অন্য গ্রামের পাকা রাস্তা পানিতে ভেসে গিয়ে স্থান ভেদে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার চার-পাঁচ ফুট গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়েছে সড়ক যোগাযোগ।

চার মাস ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে মাড়িয়ালা, হাজরাখালী, বকচর, কলিমাখালী, হিজলিয়া, কোলা, নাকতাড়া, গাজীপুর, গোরাখারআটি, নাসিমাবাদ, বালিয়াখালি, মহিষকুড়, পুইজালাসহ শ্রীউলা ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের লাখো মানুষ। ভিটে মাটি ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে, আশ্রয় কেন্দ্রে, নৌকায় ও পানির উপর টোঙ ঘরে কোনোমতে জীবনযাপন করছেন তারা। নেই সুপেয় খাবার পানির ব্যবস্থা। ভেসে গেছে পায়খানা ঘরগুলোও। ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া চুলকানিসহ পানিবাহিত নানা রোগ।

ভাঙনকবলিত পাঁচটি পয়েন্টের মধ্যে চারটি পয়েন্ট স্থানীয় এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেওয়া রিং বাঁধ টিকলেও টেকেনি হাজরাখালী পয়েন্টের রিং বাঁধ। ফলে হাজরাখালী পয়েন্টের ভাঙন সর্বশেষ আমাবশ্যায় আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে গোটা ইউনিয়নকে যেমন প্রতিদিনের জোয়ারে তলিয়ে দিচ্ছে, তেমনি ভাটায় জোয়ারে প্রবেশ করা পানি আরও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, গাছপালা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নদীতে।

আর মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস মৎস্য ঘেরসমূহ তো ভেসে গেছে আম্পানের সময়ই। বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র, গরুছাগল, শাক-সবজি, খাদ্যশস্য সবকিছু ভেসে গিয়ে সর্বত্র দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। নেই কোনো কাজ কর্ম। নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও। ভিটেমাটির মায়ায় চার মাস ধরে সংগ্রাম করলেও বাধ্য হয়ে অনেকেই বাড়ি-ঘর বা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্যত্র।

আর এখন সর্বশেষ পন্থা হিসেবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল নিজ উদ্যোগ সাড়ে সাত কিলোমিটার এলাকায় মূল বেড়িবাঁধ থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে পাকা রাস্তার উপর বাঁশ-খুটি ও মাটির বস্তা দিয়ে রিং বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও জোয়ারের প্রবল চাপে তা টিকছে না। এক্সাভেটর দিয়ে রাস্তার পাশ থেকে মাটি তুলে রাস্তার এক পাশে উঁচু করে পানি আটকানোর চেষ্টা করলেও মুহূর্তেই তা ভেসে যাচ্ছে।

সরেজমিনে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মাড়িয়ালা থেকে হেটে হাজরাখালী গিয়ে ফেরার পথে দেখা যায়, রাস্তার উপর কোমর পানি। প্রবল স্রোত। ভেসে যাচ্ছে রিং বাঁধের মাটির বস্তা। উপড়ে যাচ্ছে বাঁশের বল্লী।

হাজরাখালীর আব্দুল মান্নান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, প্রথমে বাপের কবর ভেসে গেল। তারপর বাড়ি-ঘরসহ ভিটেমাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেল। শুধু আমাদের না, হাজরাখালী দেড় শতাধিক পরিবারের ভিটে মাটি আর কোনো দিন ফিরে পাওয়া যাবে না। যেখানে বাড়িঘর ছিল সেখানে এখন ৩০-৪০ ফুট গভীর খাল হয়ে গেছে।

মাড়িয়ালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রিত বৃদ্ধ বাবর আলী সরদার বাংলানিউজকে বলেন, পাকা বাড়ি বানিয়েছিলাম। বানের পানিতে সব গেছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে স্কুলের বারান্দায় চারটে মাস কেটে গেল।

মাড়িয়ালা গ্রামের যুবক মোস্তফা কামাল বাংলানিউজকে বলেন, জোয়ার-ভাটায় ভাসতে ভাসতে শ্রীউলা ইউনিয়নের মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে হাহাকার। চার মাসে যে ক্ষতি হলো আগামী ১০০ বছরেও এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। হয়তো এখানে আর মানুষের বসতি থাকবে না।

গৃহবধূ সখিনা বেগম বাংলানিউজকে জানান, কারো সংগ্রহে কোনো খাবার নেই। কোনো কাজ-কর্মও নেই। ঘরবাড়ি, রাস্তা-ঘাট ভেসে গেছে। এলাকায় এখন ভ্যানও চলে না। ধনী-গরীব সব সমান হয়ে গেছে। কারও কাছে একমুঠো চাল ধার চাইলেও তা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই আর।

শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল বাংলানিউজকে বলেন, শ্রীউলা ইউনিয়নে আট হাজার ১১৮টি পরিবার। এর মধ্যে চার হাজার ৭৩৭টি পরিবারের ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। ইউনিয়নের ২২টি গ্রামে প্রবল স্রোতে জোয়ারভাটা খেলছে। মানুষ মরলেও দাফনের জায়গাও নেই। এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রথমে আমরা কাজ করলাম। পরে সেনাবাহিনী কাজ করলো।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু শেখর বাংলানিউজকে বলেন, শ্রীউলা ও প্রতাপনগরে যে অবস্থা তাতে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বেড়িবাঁধ নির্মাণের নতুন ডিজাইন হয়েছে। আমরা আশা করছি আগামী এক মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে।

তিনি আরও বলেন, আপাতত রাস্তার উপর রিং বাঁধ দেওয়ার জন্য আমরা কিছু বাঁশ খুটি ও বস্তা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যে চাহিদা স্থানীয়ভাবে দেওয়া হয়েছে, তাতে সাড়ে সাত কিলোমিটার রিং বাঁধের জন্য অন্য খরচ বাদে বাঁশ খুটি ও বস্তা কিনতেই খরচ হবে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। চাহিদা পাওয়া মাত্রই বরাদ্দ চেয়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই চাহিদা অনুযায়ী বাঁশ খুঁটি ও বস্তা দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।