ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ভেসে আসা কয়লায় জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা হাওরাঞ্চলবাসীর

মো.আশিকুর রহমান পীর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০
ভেসে আসা কয়লায় জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা হাওরাঞ্চলবাসীর নদী থেকে হাতে টানা জাল দিয়ে কয়লা ছেঁকে তোলা হচ্ছে। ছবি: বাংলানিউজ

সুনামগঞ্জ: দীর্ঘদিন ধরেই তাহিরপুরের ৩টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতীয় কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি বন্ধ রয়েছে। অপরদিকে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ সীমান্ত নদী যাদুকাটায় পরিবেশের বিপর্যয় রক্ষার্থে বালু পাথর উত্তোলনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন নিম্নআয়ের মানুষ।

অস্তিত্বের লড়াইয়ে ঠিকে থাকতে পড়েছেন জীবন ও জীবিকার সংকটে।  

এই যখন পরিস্থিতি তখন সীমান্তের ওপার থেকে যাদুকাটা নদীতে ভেসে আসা কয়লায় কর্মহীন কয়েক হাজার পরিবারের লোকজন খুঁজে পেয়েছে উপার্জনের শেষ আশ্রয়স্থল।

শুল্ক স্টেশন দিয়ে কয়লা, চুনাপাথর আমদানি ও যাদুকাটা নদীতে কাজ বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়ে পুরো জেলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। আর এ সমস্যা থেকে স্থায়ী উত্তরণের জন্য বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধুই এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর না করে শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে এ অঞ্চলে কাঁচবালি শিল্প, মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট বা পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভবনা।  

সারা পৃথিবীর মতো হাওরাঞ্চলেও চলমান করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কয়েক দফার বন্যা। এ অবস্থায় দিন যত গড়াচ্ছে হাওরবাসীর জীবন ও জীবিকার সংকট যেন সমানতালে বেড়ে চলছে।

যেখানে প্রতিদিনের নিয়মিত চিত্র ছিল শ্রমজীবী লোকজন দলবেঁধে দিনের শুরু থেকে সন্ধ্যা অবধি শুল্ক বন্দর ও যাদুকাটা নদীকে মুখরিত করে রাখতো সেখানে এখন বিরাজ করছে কর্মহীন শ্রমজীবী লোকদের আহাজারি।

তাছাড়া কয়েক দফা বন্যায় হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে, হাওর ও নদী তীরবর্তী ঘরবাড়ি ভাঙনের পাশাপাশি, গবাদি পশু নিয়েও হাওরবাসী পড়েছিল বিপাকে, যার প্রভাব পড়েছিল কোরবানির পশুর হাটে।

সারা বছর দু-চোখে স্বপ্ন নিয়ে যারা কোরবানিতে পশু বিক্রি করার উদ্দেশে পালন করেছিলেন কিন্তু বসতভিটাসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় গরু হাটেও নিতে পারেননি অনেকে। এর মধ্যে কেউ কেউ কম দামেই পশু বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে সারা বছর শ্রমে-ঘামে তৈরি কোরবানির পশু ভালো দামে বিক্রির স্বপ্নও বন্যায় ভেসে যায়।

যাদুকাটা নদী ও শুল্ক বন্দরে গিয়ে দেখা যায় সুনসান নিরবতা। একটা সময় যেখানে হাজারো শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কোলাহলে মুখরিত হতো এখন সেখানে শ্রমিকদের অনুপস্থিতিতে নিস্তব্ধতাই জানান দিচ্ছে কতটা জীবন ও জীবিকার সংকটে পড়েছেন দুর্গম হাওরাঞ্চলের এসব নিম্নআয়ের মানুষ।

অপরদিকে যাদুকাটা নদীতে গিয়ে দেখা মেলে, ভারত থেকে প্রবাহিত স্রোতে বালুর সঙ্গে মিশে থাকা কয়লা শ্রমজীবী লোকজন ছোট ছোট ঠেলা জাল দিয়ে পানি ছেঁকে বালু থেকে আলাদা করে বস্তায় ভরে রাখছেন। পরে প্রতি বস্তা কয়লা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় স্থানীয় মহাজনদের কাছে বিক্রি করে তা দিয়েই কোনোরকম সংসারের অভাব অনটন দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  

যাদুকাটা নদী তীরবর্তী গড়কাটি গ্রামের বাসিন্দা সাবিবুর মিয়া বলেন, যাদুকাটা নদীতে অনেকদিন ধরে কাজ বন্ধ থাকায় শত শত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা অভাব অনটনে দিন পার করছেন। এখন বালুর সঙ্গে মিশে থাকা কয়লাই জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। করোনার সময়ে সরকারি সাহায্য সহযোগিতাও আমরা ঠিকমতো পাইনি। কাজের সন্ধানে কোথাও যেতেও পারছিনা। এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।  

মানিগাঁও গ্রামের হাবিবুর মিয়া বলেন, নদীতে কাজ বন্ধ থাকার কারণে আমাদের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। ২-৩ দিন ধরে ঘরে চাল নিতে পারিনি এমনও সময় যাচ্ছে, পরে সুদে দেনা করে টাকা আনছি। আর এখন বালুর সঙ্গে মিশে থাকা কয়লা বিক্রি করে কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে চলছি।

দীর্ঘদিন শুল্ক বন্দর ও যাদুকাটা নদীতে কাজ বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যিক কেন্দ্র বাদাঘাট বাজারসহ উপজেলার অন্যান্য বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও।  

এ বিষয়ে বাদাঘাট বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, নদীতে কাজ না থাকায় এবং শুল্ক স্টেশন বন্ধ হওয়ায় এলাকার শ্রমজীবী লোকজন মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। আর শ্রমিকদের কাজ বন্ধ থাকায় বাজারগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। বেচাকেনা কম থাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যবসায়ীরা অলস সময় পার করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেক ব্যবসায়ী বড় আকারের অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে এবং এ সংকট থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।  

যাদুকাট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান (বাদাঘাট উ. ইউপি) নিজাম উদ্দিন বলেন, যাদুকাটা নদীতে কাজ বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা পরিবার পরিজন নিয়ে অভাব অনটনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কাজের সন্ধানে নানান দিকে ছুটাছুটি করছে এসব নিম্নআয়ের লোকজন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এলাকায় চুরি, ছিনতাই বেড়ে যেতে পারে তাই জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি পরিবেশ সম্মত উপায়ে যাদুকাটা নদীতে শ্রমিকদের কর্মের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে হাওরাঞ্চলে যেন স্বস্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। সর্বোপরি এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পনা মোতাবেক স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টির উপায় বের করাও এখন সময়ের দাবি।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি সরেজমিনে আমি যাদুকাটা নদী এবং টেকেরঘাটে গিয়েছি এবং সেখানকার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা হাওরাঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছি। যাদুকাটা নদীতে বালু পাথর উত্তোলনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। তবে নদী থেকে হাত বা ঠেলা জাল দিয়ে শ্রমিকরা যে কয়লা, লাকড়ি সংগ্রহ করছেন তাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই কিন্তু নদীর পাড় কেটে, পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে, ইঞ্জিনচালিত মেশিন চালিয়ে কোনো কাজ করা যাবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।