ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দল-মত নির্বিশেষে ২০১৯ সালে বিভিন্ন খাতের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’শুরু করে আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন বাহিনী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান এসব অভিযানের নের্তৃত্ব দেয় পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুলে ইয়াং ম্যান্স ক্লাবে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু করে র্যাব। এরপর একে একে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য ক্লাবগুলোতে র্যাবের ধারাবাহিক অভিযানে বেরিয়ে আসতে থাকে ক্যাসিনোর অন্ধকার জগৎ। ঢাকা মহানগর দক্ষিন যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ একে একে গ্রেফতার হন ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন বড় নেতা।
বর্তমান সরকারের অন্যতম আলোচিত এ 'শুদ্ধি অভিযান' ছিল মূলত টেন্ডারবাজ, দুর্নীতিবাজ, মাদক এবং ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে। ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর এক বছর পর তা বন্ধ হয়নি, বরং তা সাম্প্রতিক সময়েও অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
বহিষ্কৃত জানায়, রাজধানীতে আটটি ও বন্দর নগরীতে তিনটি ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে আনুমানিক ২৭০ কোটি টাকার মতো এফডিআর ও নগদ টাকা উদ্ধার হয়।
ক্যাসিনো অভিযানের ঘটনায় ৩২টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালত ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে ১৪টি মামলা তদন্ত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় র্যাব। এর মধ্যে ১৪টি মামলার মধ্যে ১৩টি মামলার চার্জশিট বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বাকি একটি মামলা আদালতের নির্দেশক্রমে চার্জশিট স্থগিত আছে।
র্যাব সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী অভিযান পরিচালিত ক্লাবগুলো হলো- ফকিরাপুল ইয়াং ম্যান্স ক্লাব, ওয়ান্ডার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ, কলাবাগান ক্রীড়া চক্র, ধানমন্ডি ক্লাব, ফু-ওয়াং ক্লাব এবং চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, আবাহনী ক্লাব, মোহামেডাম ক্লাব। এসব ক্লাব থেকে উদ্ধারকৃত ক্যাসিনো সামগ্রীর দাম প্রায় কয়েক কোটি টাকা।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে ফকিরাপুলের ইয়াং ম্যান্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। ওইদিন রাতেই একে একে ওয়ান্ডার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ক্যাসিনোর পায়। একই দিন রাতে ঢাকা মহানগর দক্ষিন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার করেন র্যাব সদস্যরা।
২০ সেপ্টেম্বর আরেক যুবলীগ নেতা ‘টেন্ডারবাজ’ খ্যাত জি কে শামীমকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার অফিস থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার করা হয়। একই দিন রাতে রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ও ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়, গ্রেফতার করা হয় কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষকলীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে।
২৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর মনিপুরী পাড়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদকসহ গ্রেফতার করা হয় বিসিবির পরিচালক ও মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে। ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় থাইল্যান্ডগামী এক বিমান থেকে নামিয়ে আনা হয় অনলাইন ক্যাসিনোর জনক সেলিম প্রধানকে।
৬ অক্টোবর সবচেয়ে আলোচিত ঢাকা মহানগর দক্ষিন যুবলীগের সভাপতি (পরে বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী এমরানুল হক আরমানকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। অভিযানে খালেদ মাহমুদ ভুইয়া ও ঈসমাইলন হোসেন চৌধুরী সম্রাটের অফিসে টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া যায়। যেখান থেকে টর্চারের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার লাঠি ও ইলেকট্রিক শক দেওয়া মেশিন জব্দ করা হয়েছে।
গত ১১ অক্টোবর ভোরে শ্রীমঙ্গলের কলেজ গেট এলাকার এক বান্ধবীর বাসা থেকে একটি অবৈধ পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগজিন ও নগদ দুই লাখ টাকাসহ র্যাবের একটি দল গ্রেফতার করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে।
ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর আত্মগোপনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবকে গত ১৯ অক্টোবর রাতে রাজধানীর ভাটারা এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর গত ৩১ অক্টোবর টিকাটুলির নিজ কার্যালয় থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুকে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালনাক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের এক বছর। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হয়। সারা দেশব্যাপী ক্যাসিনো বিরোধী যে অপারেশন বর্তমান সময়ে স্থগিত আছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে র্যাবের ক্যাসিনো বিরোধী অপারেশন ফৌজদারি দণ্ডবিধি চলমান রয়েছে।
এরমধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনভিত্তিক ক্যাসিনো অপারেশন র্যাব সাম্প্রতিক সময়েও পরিচালনা করে আসছে। অর্থাৎ, ক্যাসিনো বিরোধী যে অভিযান তা বর্তমানেও অব্যাহত আছে।
ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতার সম্রাট ও জি কে শামীমদের মতো গডফাদার বা তাদের প্রশ্রয়দাতাদেরও চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে জানানো হলেও কার্যত পরবর্তিতে দেখা যায় নি, এ বিষয়ে আশিক বিল্লাহ বলেন, মূলহোতা বা পৃষ্ঠপোষক এরকম কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমেও এসেছে যা র্যাবের নজরে এসেছে। এখানে মূলত র্যাব পরিষ্কার করতে চায়, ফৌজদারি অপরাধভিত্তিক যে বিষয়গুলো থাকে সেগুলোতে র্যাব চার্জশিট দাখিল করেছে। চার্জশিট দাখিল হওয়ার পর পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। বিচার প্রক্রিয়ায় যদি এরকম কোনোকিছু উপস্থাপিত হয় তাহলে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অনলাইন ক্যাসিনোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন ভিত্তিক ক্যাসিনো সেটি র্যাবই সর্বপ্রথম আলোচনায় নিয়ে আসে এবং এর মূল আসামি কারা হেফাজতে আছে। এছাড়াও বর্তমান সময়ে ছোটখাটো যে অভিযোগগুলো পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনভিত্তিক, কিন্তু তারা সেরকম কোনো বড় গ্রুপ নয়, ছোটখাটো বিদেশি ডোমেইন থেকে মূলত এগুলা পরিচালিত হয়। এরকম বেশ কিছু বিষয় র্যাবের নজরে এসেছে এবং সে সকল বিষয় নিয়েও র্যাব কাজ করছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
পিএম/এমএমএস