ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মসজিদে বিস্ফোরণ: নিভে গেল মেহের আলীর নয়নের আলো

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২০
মসজিদে বিস্ফোরণ: নিভে গেল মেহের আলীর নয়নের আলো নিহত নয়নের বাড়িতে স্বজনরা, ইনসেটে নয়ন। ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: নারায়ণগঞ্জে মসজিদের এসি বিস্ফোরণের ঘটনায় নিভে গেছে ভূমিহীন দিনমজুর মেহের আলীর চোখের আলো। সংসারে আলো জ্বালানো একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান শুকর আলী নয়নের (২৬) মৃত্যুর খবরে স্তব্ধ হয়ে গেছে মেহের আলীসহ পুরো গ্রাম।

 

শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নয়ন।  

নয়ন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তালুক পলাশী কৈটারী গ্রামের ভূমিহীন দিনমজুর মেহের আলীর বড় ছেলে।  

নয়নের পরিবারের সদস্য ও গ্রামবাসী জানায়, ভূমিহীন দিনমজুর মেহের আলী তিন ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর মৃত খতিবুদ্দিনের বাড়িতে ঘরজামাই  থাকতেন। বাবার অভাবের সংসারে হাল ধরতে ১৩ বছর আগে ৫ম শ্রেণি পাস করে ঢাকায় পাড়ি জমায় শুকর আলী নয়ন। সেই থেকে নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করত নয়ন। এর পর থেকে নয়নের আলোয় আলোকিত হতে শুরু করে ভূমিহীন মেহের আলীর সংসার। তার আয়ে একমাত্র বোনের বিয়ে এবং ছোট দুই ভাইকে হাফেজিয়া মাদরাসায় পড়ানোসহ সংসারের যাবতীয় খরচ চলতো।  

ভূমিহীনের খাতা থেকে বাবার নাম কেটে দিতে সম্প্রতি ১৪ শতাংশ জমি কিনে একটি টিনের ঘর তুলে বাবা মায়ের বসবাসের ব্যবস্থা করেন নয়ন। সেই জমির পুরো টাকা পরিশোধ না হওয়ায় তা রেজিস্ট্রিও করে নিতে পারেননি তিনি। কথা ছিল ধীরে ধীরে টাকা পরিশোধ হলে জমি রেজিস্ট্রি করে দেবেন জমির মালিক খালাত ভাই ওবায়দুল। কিন্তু সেই টাকা পরিশোধ না হতেই মেহের আলীর সংসারের আলো জ্বালানো প্রদীপটি চিরতরে নিভে গেল।  

শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদের এসি বিস্ফোরণে ৩৭ জন দগ্ধ হন। সেখানে দগ্ধ হয়ে ঢাকা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন পোশাক শ্রমিক শুকর আলী নয়ন। সেখানে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শনিবার চলে যান না ফেরার দেশে। শনিবার দুপুরে নয়নের মৃত্যুর খবর গ্রামে পৌঁছালে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো কৈটারী গ্রাম।

প্রিয় সন্তানের দগ্ধ নিথর দেহ দেখতে অপেক্ষা করতে থাকেন বৃদ্ধ বাবা মেহের আলী আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী। সংসারের প্রদীপকে হারানোর শোকে বারবার মুর্ছা যান বাবা মেহের আলী। গ্রামবাসী ও স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন।  

রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) ভোরে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে এতে পৌঁছায়। পরে সকাল ১০টায় জানাজা শেষে স্থানীয় পলাশী বাজার কেন্দ্রীয় কবর স্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে।  

নয়নের গ্রামের বন্ধু জয়নাল আবেদীন জানান, গ্রামের সবার প্রিয় ছিল নয়ন। বোনের বিয়ে দেওয়ার পরে বাড়ি করার জমি কিনেছিল। সেই জমির টাকা পরিশোধ করে রেজিস্ট্রি করে নিয়ে নিজে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন তার পূরণ হলো না।  

নয়নের মামি শরিফা বেগম জানান, বাবার অচল সংসারটির হাল ধরেছিল নয়ন। বোনের বিয়ে ছোট ভাইদের লেখাপাড়া ও সংসার খরচ সবই চলতো তার টাকায়। এখন এ সংসার কীভাবে চলবে?

নয়নের বাবা মেহের আলী বলেন, নামাজে যাওয়ার আগেও মোবাইলে বাড়ির খবর নিয়েছিল নয়ন। বলেছিল- বাবা এখন নামাজে যাচ্ছি। নামাজ শেষে বাসায় গিয়ে ঘুমাবো। আজ আর কথা হবে না। কাল সকালে কথা হবে। এ কথা বলেই সজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন মেহের আলী।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ