ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী আব্দুল জব্বারের মৃত্যু

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২০
আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী আব্দুল জব্বারের মৃত্যু

পিরোজপুর: যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে ফেরারি আসামি আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার  (৮৮)  মারা গেছেন।  মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) সকালে তিনি আমেরিকার ফ্লোরিডায় তার মেয়ের বাসায়  আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মারা যান।

 

পারিবারিক সূত্র তার মৃত্যুর বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যানসার আক্রান্ত অবস্থায় আমেরিকায় তার বড় মেয়ের বাসায় আত্মগোপনে থেকে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার বাড়ি মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের খেতাচিড়া গ্রামে।

আরো পড়ুন: জব্বারের আমৃত্যু কারাদণ্ড

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার অভিযুক্ত হন হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্মান্তরিতকরণ এবং বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২)/এ, ৩(২)/সি, ৩(২)/ডি, ৩(২)/জি ও ৩(২)/এইচ এবং ২০(২) ধারা অনুসারে গঠন করা এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ৩৬ জনকে হত্যা-গণহত্যা, ১৫ জনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও গুরুতর জখম, ২শ’ জনকে ধর্মান্তরিতকরণ এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে ৫শ’ ৮৭টি বাড়ি-ঘর ধ্বংস করার অভিযোগ।  

এসব অভিযোগের মধ্যে সবগুলো অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।

রায়ে ১ নম্বর (দুই মুক্তিযোদ্ধা হত্যা ও ১৬০টি বাড়িতে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ), ২ নম্বর (শারদা কান্ত পাইককে হত্যা ও ৩৬০টি বাড়িতে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ), ৩ নম্বর (১২ জনকে গণহত্যা ও ৬০টি বাড়িতে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ) এবং ৪ নম্বর (২২ জনকে গণহত্যা ও ১৫ জনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন, গুরুতর জখম) অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন আজহার। এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগে ২০০ জনকে ধর্মান্তরিতকরণের দায়ে আরও ২০ বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে।

১৯৭১ সালের আগের মুসলিম লীগের নেতা আব্দুল জব্বার ১৯৫৬ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা শ্বশুরের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় জড়ান জব্বার। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বে মঠবাড়িয়া থানায় রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। জব্বার ছিলেন থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। আত্মীয় ইস্কান্দার মৃধাকে তিনি রাজাকার কমান্ডার করেন।

জব্বারের নেতৃত্বে ও তার উপস্থিতিতে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি, নলী ও আঙ্গুলকাটা গ্রামে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয় বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।

১৯৮৮ ও ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার।

চার অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড
প্রমাণিত প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের নেতৃত্বে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৬ মে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি গ্রামের দুই মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাক বিশ্বাস ও মোতালেব শরীফকে হত্যা করে। এছাড়া গ্রামের নাথপাড়া ও কুলুপাড়ার আনুমানিক ১৬০টি বাড়িতে লুট এবং অগ্নিসংযোগ করে।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৭ মে ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি গ্রামে আক্রমণ করে। তারা গ্রামের শারদা কান্ত পাইককে হত্যা এবং ৩৬০টি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ মে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের নিয়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার নলী গ্রামে আক্রমণ করেন। জব্বার নিজে তার হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন গ্রামের সাখানাথ খরাতীকে। জব্বারের নির্দেশে রাজাকাররা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে গ্রামের নিশিকান্ত বিশ্বাস ও তার ছেলে সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, জিতেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, গণেশ চন্দ্র মিস্ত্রি, উপেন্দ্র নাথ মিস্ত্রি, বসন্ত হালদার, বলরাম মিস্ত্রি, ষষ্ঠী হালদারকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন গ্রামের মোট ১১ জন শহীদ হন। রাজাকাররা গ্রামের ৬০টি বাড়ির মালামাল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।

পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার আঙ্গুলকাটা ও মঠবাড়িয়া গ্রাম থেকে ৩৭ জনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও তাদের মালামাল লুণ্ঠন করে রাজাকাররা। জব্বার ইঞ্জিনিয়ার তাদের মধ্য থেকে ৭ জনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন। বাকি ৩০ জনকে সূর্যমনি নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে জব্বারের নির্দেশে গুলি করা হয়। ওইদিন ২২ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন এবং বাকি ১৫ জন গুরুতর জখম হন।

ধর্মান্তরিতকরণে আরও ২০ বছর

চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তর সালের ১৬ মে তুষখালী হাইস্কুল মাঠে ইঞ্জিনিয়ার জব্বার মিটিং করেন। ওই মিটিংয়ে হিন্দুদেরকে তিনি ‘পাকিস্তানের শত্রু’  তাদের অর্থ-সম্পত্তিকে ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণায় রাজাকাররা ফুলঝুড়ি গ্রামের সাতটি বাড়িতে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে। জব্বারের নির্দেশে রাজাকাররা গ্রামের প্রায় দুইশ’ নিরস্ত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তর করে এবং তাদের নাম পরিবর্তন করানো হয়।

বেলা এগারোটা ১০ মিনিট থেকে বারটা ৮ মিনিট পর্যন্ত পর্যন্ত জব্বারের মামলার রায়টি পাঠ করেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে রায়ের প্রথম অংশ পাঠ করেন বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারক প্যানেলের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। সবশেষে রায়ের শেষ অংশ অর্থাৎ মূল রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

মোট ১৪১ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ করা হয়।

এর আগে বেলা এগারটার দিকে ট্রাইব্যুনালে এসে বেলা এগারটা ৮ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে আসন নেন বিচারপতিরা। শুরুতে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা বক্তব্য দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২০
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।