ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ৫ কর্মকর্তার নেতৃত্বেই নির্যাতন’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২০
‘যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ৫ কর্মকর্তার নেতৃত্বেই নির্যাতন’ সংবাদ সম্মেলন/ ছবি: বাংলানিউজ

যশোর: যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ৫ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কিশোর বন্দিদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। এই নির্যাতনে ৩ কিশোর নিহত ও ১৫ জন আহত হয়।

পুলিশ ওই পাঁচ কর্মকর্তাকে আটক করেছে। এছাড়াও মারপিটে অংশ নিয়েছিল কর্মকর্তাদের অনুগত ৭/৮ কিশোর বন্দি।

এর আগে চুল কাটা নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই মারপিট করা হয়। গত ১৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে হতাহতের ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

শনিবার (১৫ আগস্ট) দুপুরে প্রেসব্রিফিং করে প্রাথমিক তদন্তের এসব তথ্য জানান যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন।  

আটক কর্মকর্তারা হলেন, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক প্রবেশন অফিসার মাসুম বিল্লাহ, কারিগরি প্রশিক্ষক ওমর ফারুক, ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর একেএম শাহানুর আলম ও সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান।  

শুক্রবার ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হেফাজতে নেওয়া হলে মামলার পর রাতে এই ৫ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়।  

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
ঈদুল আজহার পর গত ৩ আগস্ট ঘটনার সূত্রপাত হয়। এদিন কিশোর বন্দি হৃদয়কে (যে চুল কাটায় পারদর্শী) চুল কেটে দিতে বলেন কেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রধান (হেড গার্ড) নূর ইসলাম। ঈদের আগে হৃদয় প্রায় দুইশ বন্দির চুল কাটায় তার হাত ব্যথা উল্লেখ করে চুল কাটতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নূর ইসলাম কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহর কাছে অভিযোগ করেন, ‘ওরা ট্যাবলেট খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। ’ এছাড়াও তিনি হৃদয় ও তার বন্ধু পাভেলের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত করেন। সেখানে উপস্থিত কিশোর নাঈদ অভিযোগ শুনে বিষয়টি পাভেলকে জানিয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাভেল তার কিছু অনুসারী কিশোরকে নিয়ে নূর ইসলামকে মারপিট করে। এতে তার হাত ভেঙে যায়। এ ঘটনার সূত্র ধরেই ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।  

কী ঘটেছিল ১৩ আগস্ট
জাতীয় শোকদিবস পালন উপলক্ষে ১৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় ‘নূর ইসলামের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি প্রদানের’ সিদ্ধান্ত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শনাক্ত হামলাকারী ১৩ জনসহ আরও কয়েকজনকে বের করে আনা হয়। ওই পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের আজ্ঞাবহ ৭/৮ জন কিশোর বন্দি ‘অভিযুক্তদের’ মারপিট শুরু করেন।

এসময় তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। মুখে গামছা ঢুকিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাইরে বের করে টেনে ধরে পেছনে বেধড়ক মারপিট করা হয়। লোহার রড, ক্রিকেট স্ট্যাম্প ইত্যাদি দিয়ে বেপরোয়া মারপিট করা হয়। অচেতন হয়ে গেলে বন্ধ করে ফের জ্ঞান ফিরলে মারপিট করা হয়। পালাক্রমে এভাবে মারপিটের পর গুরুতর জখম অবস্থায় এদের একটি ঘরে ফেলে রাখা হয়। একজন ‘কম্পাউন্ডার’ দিয়ে সামান্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও এদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়।  

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মৃতপ্রায় অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে এক অবর্ণনীয় পরিবেশ দেখতে পান। নির্যাতনের শিকারদের দুপুরে খাবার না দিয়ে, চিকিৎসা না দিয়ে গরমের মধ্যে গাদাগাদি অবস্থায় ফেলা রাখা হয়েছিল। এরই মধ্যে আরও দু’জনকে হাসপাতালে পাঠানো হলে তারাও মারা যায়। পরে অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের পিকআপে করে ১৪ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন আরও একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।  

এ নিয়ে এই মর্মান্তিক ঘটনায় তিনজন নিহত ও ১৫ জন আহত ছিল।  

নিহতরা হলো, বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্বপাড়ার নান্নু পরমানিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮)। নাঈম হোসেন ধর্ষণ এবং রাব্বি হত্যা মামলার আসামি ছিল।  

ঘটনার পর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা দুপক্ষের সংঘর্ষে হতাহতের কথা বললেও পরবর্তীকালে আহত কিশোর বন্দিদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসতে শুরু করে। পুলিশ দ্রুত তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্রের ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নেয়।

১৪ আগস্ট সন্ধ্যারাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন নিহত পারভেজ হাসান রাব্বির (১৮) পিতা রোকা মিয়া। মামলায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়। মামলার পর পুলিশ হেফাজতে নেওয়া ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করে।

এদিকে, শুক্রবারই তিন কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি গঠন করা হয় দুটি তদন্ত কমিটি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শুক্রবার বিকেলে তিন সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটি গঠন দেন। যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।  
তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান করা হয়েছে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবুল লাইছকে। এছাড়া সদস্যসচিব সমাজসেবা অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা এবং সদস্য করা হয়েছে জেলা পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি, যিনি এএসপি পদমর্যাদার নিচে নন। কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।  

এর আগে সমাজসেবা অধিদপ্তর দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ওই কমিটির প্রধান করা হয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মোহাম্মাদ নুরুল বসিরকে। তার সাথে তদন্তকাজে সহায়তা করবেন উপপরিচালক (প্রতিষ্ঠান-২) এসএম মাহমুদুল্লাহ। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন আরও জানান, ওই তদন্ত কমিটির পাশাপাশি পুলিশও মামলার তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। ওই মিটিংয়ে থাকা ১৯ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জড়িত হিসেবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হওয়ায় ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হবে। এছাড়াও জড়িত ৭/৮ কিশোর বন্দিকে এই মামলায় আইনের আওতায় আনতে আদালতে আবেদন করা হবে।  

পুলিশ সুপার উল্লেখ করেন, তারা ঘটনার বিশ্লেষণ করে সর্তকতার সঙ্গে মামলার তদন্তকাজ পরিচালনা করছেন। যাতে প্রকৃত চিত্র ও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন।  

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. তৌহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম রাব্বানী, যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২০
ইউজি/এইচএডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।