ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রাতারাতি বদলে যায় চার পত্রিকার ভূমিকা

মহিউদ্দিন মাহমুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২০
রাতারাতি বদলে যায় চার পত্রিকার ভূমিকা

ঢাকা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দৈনিক পত্রিকাগুলো রাতারাতি বদলে গিয়েছিল। যেন হয়ে উঠেছিল খন্দকার মোশতাক সরকারের মুখপত্র।

দেশের রাষ্ট্রপতি যে সপরিবারে খুন হয়েছেন, ১৬ আগস্টের পত্রিকা পড়ে তা বোঝার উপায় ছিল না।

তখন দেশে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস নামের চারটি দৈনিক পত্রিকাই শুধু প্রকাশিত হতো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত চারটি সংবাদপত্রেই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান এবং বিভিন্ন কর্মসূচির খবর। অথচ ১৬ আগস্ট সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল ঠিক উল্টো। সেদিনের গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতাগ্রহণ। নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়ে পত্রিকাগুলো সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। একইসঙ্গে শেখ মুজিব ও তার সরকারবিরোধী বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করা হয়।

ভয়াবহ এক হত্যাযজ্ঞ ঘটে গেলেও এদিনের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবিও ছাপা হয়নি। বড় করে ছাপানো হয়েছিল খন্দকার মোশতাকসহ নতুন সরকারের মন্ত্রীদের ছবি। ইত্তেফাক
স্বাধীনতার আগে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাককে আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবেই মনে করা হতো। ১৬ আগস্টে সেই ইত্তেফাকেও বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার খবর ছিল গুরুত্বহীন।

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট প্রকাশিত তৎকালীন সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকে ৬ কলামে প্রধান সংবাদ ছিল ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’। এই সংবাদটির প্রধান শিরোনামের শোল্ডারে লেখা ছিল ‘দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ। । সুবিচার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা’।

এই প্রতিবেদনটির সূচনায় লেখা হয়েছিল- ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন। ’

এরপর লেখা হয়েছিল- ‘শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন। ’

নারী-শিশুসহ ঘাতকদের গুলিতে নির্মমভাবে অন্যদের নিহত হওয়ার কথা লুকানো হয় সংবাদটিতে।

৬ কলামে ছাপা প্রধান সংবাদের পাশে দুই কলামে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ শিরোনামে ছাপা হয় সম্পাদকীয়।

৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ‘উপরাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ’, ‘জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস’, ‘বিভিন্ন মহলের অভিনন্দন’, ‘যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালাইয়া যাইবে’, ‘বিদেশি দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকিবে’, ‘নতুন সরকারের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি’, ‘নতুন সরকারের জন্য বিশেষ মোনাজাত’ শিরোনামে আরও কয়েকটি সংবাদ ছিল।  

খন্দকার মোশতাকের শপথ গ্রহণের ছবি বড় করে ছাপানো হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি ছাপা হয়নি।

সে সময় ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী এবং বার্তা সম্পাদক ছিলেন আসাফউদ্দৌলা রেজা। দৈনিক বাংলা
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এহতেশাম হায়দার চৌধুরী সম্পাদিত ‘দৈনিক বাংলা’ খবরের কাগজটিও বদলে যায় রাতারাতি।  

১৬ আগস্ট প্রকাশিত দৈনিক বাংলায় আট কলামের শিরোনাম ছিল- ’খন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি। ’ প্রধান শিরোনামের শোল্ডারে লেখা ছিল– ‘শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ’।

প্রথম পাতায় বক্স করে দুই কলামে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ নামে সম্পাদকীয় ছাপা হয়।

দৈনিক বাংলা পত্রিকাতেও বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়া নিয়ে আলাদা কোনো সংবাদ ছাপা হয়নি। প্রধান সংবাদেও বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার নির্মম ঘটনা গুরুত্ব পায়নি।

এদিন দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপোস নেই’, ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা হবে: রাষ্ট্রপতি’, ‘দশজন মন্ত্রী ও ছয়জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘নয়া সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে’, ‘পাকিস্তানের স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত’ শিরোনামে আরও কয়েকটি সংবাদ ছাপা হয়। .দ্য বাংলাদেশ অবজারভার
ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলার মতো দুই ইংরেজি পত্রিকাতেও বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার সংবাদ গুরুত্ব পায়নি। বরং মোশতাক সরকারকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় এবং নতুন সরকারের প্রশংসা করে বিভিন্ন সংবাদ ছাপানো হয়।

১৬ আগস্ট ওবায়দুল হক সম্পাদিত সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দ্য বাংলাদেশ অবজারভারের প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘মুশতাক বিকামস প্রেসিডেন্ট’। শিরোনামের শোল্ডার ছিল- ‘আর্মড ফোর্সেস টেক ওভার: মার্শাল ল প্রোক্লেইমড: কারফিউ ইমপোজড’। প্রধান শিরোনামের নিচে লেখা ছিল, ‘মুজিব কিলড: সিচুয়েশন রিমেইনস কাম’।

প্রধান সংবাদের নিচে বক্স করে দুই কলামে ‘হিস্টরিক্যাল নেসেসিটি’ শিরোনামে ছাপা হয় সম্পাদকীয়।  

পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ছাপা অন্যান্য সংবাদের মধ্যে ছিল- ‘পিপল হেইল টেক-ওভার’, ‘স্পেশাল প্রেয়ার্স’, ‘মুশতাক কলস ফর কো-অপারেশন’, ‘পাকিস্তান অ্যাকর্ডস রেকগনিশন’, ‘ইনভায়োবিলিটি অব ফরেন মিশনস অ্যাশিউরড’, ‘জাস্টিস মাস্ট বি এসটাব্লিশড: প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ক হার্ড টু ইমপ্রুভ কনডিশন কুইকলি’, ‘ইউএস রেডি টু কনডাক্ট নরম্যাল ডিপ্লোম্যাটিক বিজনেস’, ‘কারফিউ রিল্যাক্সড ফর জুম্মা প্রেয়ার্স’ ইত্যাদি। .দ্য বাংলাদেশ টাইমস
১৬ আগস্ট আট কলামে দ্য বাংলাদেশ টাইমসের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মোশতাক অ্যাসিউমস প্রেসিডেন্সি’। এই শিরোনামের ওপরে লিখা ছিল, ‘মার্শাল ল প্রক্লেইমড ইন দ্য কান্ট্রি: মুজিব কিলড’।

আব্দুল গনি হাজারি সম্পাদিত ইংরেজি এই পত্রিকাটিতেও নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হয়। প্রধান শিরোনামের নিচে প্রথম দুই কলামে ‘আওয়ার কমেন্টস’ নাম দিয়ে ‘অন দ্য থ্রেশলড অব দ্য নিউ এরা’ শিরোনামে সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল।

পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ছাপানো অন্যান্য সংবাদের মধ্যে ছিল- ‘পিপল থ্যাঙ্ক আর্মড ফোর্সেস’, ‘মুজিবস পিকচার রিমুভড’, ‘হেল্প মেক বাংলাদেশ এ প্রসপরাস কান্ট্রি’, ‘ইউএস রেডি ফর নরমাল টাই’, “ভাইস প্রেসিডেন্ট, টেন মিনিস্টার, সিক্স স্টেট মিনিস্টার সোয়ার্ন ইন’, ‘ভ্যালুজ হ্যাভ টু বি রিহ্যাবিলিটেটেড’ ইত্যাদি।

কৃতজ্ঞতা: সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, ১৫ আগস্ট, ২০২০
এমইউএম/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।