ঢাকা: ‘দিনমজুরের ঘরে আমার জন্ম। জন্মের পর চার হাত-পা নেই দেখে বাবা-মা ছাড়া সবাই আমাকে নিয়ে নানান মন্তব্য করতো, শুনেছি বাবার মুখে!’
অভাবের সংসারে বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান।
বলছিলেন, আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে চার হাত-পা ছাড়াই। বাবা-মা কখনো আমাকে নিয়ে নিরাশ হতেন না, অন্যের কথায় কান না দিয়ে অন্যের খেতে দিন মজুরির কাজ করতেন। আমি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলাম…।
‘বয়স আমার যখন সাত বছর তখন অভাবের তাড়নায় বাবা-মা’র আমাকে নিয়ে কোনোভাবেই গ্রামে থাকা সম্ভব ছিল না, তাই চলে আসে রাজধানী ঢাকায়। ’
সম্রাট বলেন, ঢাকায় এসে উঠলাম মিরপুর ইস্টার্ন হাউসিং তালতলা এলাকায়। বাবা প্রথমে একটা গরুর ফার্মের কাজ নিলেন খুব সামান্য বেতনে, তার কিছুদিন পরেই এখানে একটি স্কুলে আমাকে ভর্তি করান। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম ওই স্কুলে। তারপরে অভাবের তাড়নায় আর পড়াশুনা করার সৌভাগ্য আমার জীবনে হলো না!
‘এরমধ্যে বাবার চাকরিটাও চলে যায়। তারপর আমরা সবাই দিশেহারা হয়ে পড়ি, একদিন না পেরে বাবা রিক্সা চালাতে বেরিয়ে যায়। তার কিছুদিনের মধ্যেই মাকেও অন্যের বাসায় কাজ করতে হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে আমাদের সংসার চালাতেন বাবা-মা। তখন আমাদের ঘরে খাওনের লোক ছিল পাঁচজন, আমরা তিন ভাই বোন ও বাবা-মা। ’
এরপর কথা হলো সম্রাটের বাবার সঙ্গে, তিনি জানালেন সংগ্রামী ও আত্মপ্রত্যয়ী ছেলের জীবনের গল্প।
সম্রাটের বাবা বজলু আকন বাংলানিউজকে বলেন, অভাবের সংসারে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকা শহরে অনেক কষ্ট করে বেঁচে আছি।
সম্রাট কিভাবে চার হাত-পা না থাকার পরেও রিকশা চালাতে নামলো রাজধানীতে- এমন প্রশ্নের জবাবে সম্রাটের বাবা বলেন, আমি যখন রিকশা চালিয়ে এসে বাসায় রেখে দিতাম তখন ও আস্তে আস্তে করে নিজেই কিভাবে রিক্সা চালানো শিখে ফেলেছিল।
‘একদিন আমাকে বলে আমি রিকশা চালাতে চাই। তোমার ও মার কষ্টের পাশাপাশি আমিও কিছু সহযোগিতা করতে চাই! তুমি আমাকে একটা রিকশা কিনে দাও বাবা! না হয় ভাড়া নিয়ে দাও তখন আমি ওকে ধমক দিয়ে বলি, তোর চার হাত-পা নাই, তুই কিভাবে রিক্সা চালাবি, রিক্সা চালানো কি এত সহজ? কিভাবে তুই রিক্সা চালাবি? তখন ও আমাকে বলে তুমি যখন ভাত খেতে বসতে ঘরে এই ফাঁকে আমি তোমার রিকশা নিয়ে আস্তে আস্তে চালানো শিখে ফেলেছি। ’
সম্রাটের বাবার ভাষ্য- আমি নিজেই শুনে অবাক হয়ে বললাম, তুই আজ থেকে ঘর থেকে বের হবি না। তোর কোন কাজ করতে হবে না। আমি ও তোর মা এখনো বেঁচে আছি না! তারপর আমি ওকে আর আমার রিকশা ধরতে দেয়নি। কিন্তু ও কিভাবে কিভাবে পাশের গ্যারেজে গিয়ে নিজেই রিক্সা ভাড়া করে নিয়ে আমাকে চুরি করে এই রাজধানী শহরে রিকশা চালানো শুরু করে।
‘একদিন কিছু টাকা এনে আমাকে দিয়ে বলে- বাবা এই নাও আমার প্রথম ইনকামের টাকা, তুমি বাজার করো! আমি বললাম তুই টাকা কোথায় পেয়েছিস? চুরি করেছিস না ভিক্ষা করেছিস? ও আমাকে বলে- বাবা আমি ভিক্ষা করি নাই, চুরিও করি নাই। আমি ওই গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে রিকশা চালিয়ে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেছি!’
এরপর থেকে একই রিক্সা সম্রাট ও আমি দুইজনে মিলে রাজধানীতে চালাচ্ছি, বলেন সম্রাটের বাবা।
সম্রাট বলেন, এই শহরে রিকশা চালাতে আমার কোনো সমস্যা হয় না। তবে অনেক সময় কিছু যাত্রী আমার রিক্সায় উঠতে চায় না, ভয় পায়। আমার চার হাত পা নাই দেখে। আবার অনেক সময় পুলিশের নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
তিনি বলেন, সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘর ভাড়া, সংসারে খরচ ও আমার মেঝ বোনটা নানাবাড়ি থেকে পড়াশুনা করে। এই খরচ সব মিলিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়!
‘আমাদের স্বপ্ন অন্যের কাছে হাত না পেতে নিজে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে গ্রামের বাড়িতে জমি কিনে ঘর করা। ঘর করার মতো টাকা আয় করতে পারলেই আমরা ঢাকা ছেড়ে চলে যাব আমার জন্মভূমিতে। ’
জীবনযুদ্ধে জয়ী সম্রাট জানান, কারো কাছে হাত পেতে বা করুণার পাত্র হয়ে আমি সম্রাট বেঁচে থাকতে চাই না। আমি নিজের মত কষ্ট করে শুধু নামে নয়, কামেও সম্রাট হয়ে আমার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবো ইনশাআল্লাহ। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০২০
এসএইচএস/এসআইএস