ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

চামড়ার দাম না পেয়ে ‘ট্যানারি মালিকদের’ উপর ক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

উত্তম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০২০
চামড়ার দাম না পেয়ে ‘ট্যানারি মালিকদের’ উপর ক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম না পেয়ে ‘ট্যানারি মালিকদের’ উপর ক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

যশোর: ঈদুল আজহার দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিপিস ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা দরে ১শ’ গরুর চামড়া কিনেছিলেন নড়াইলের লোহাগড়ার ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী সানাই বিশ্বাস। সেগুলো বাড়িতে লবণজাত করে রেখে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।

শনিবার (০৮ আগস্ট) চামড়াগুলো বিক্রি করে লাভের আশায় এসেছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তম চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাটে। চামড়ার এ বৃহৎ মোকামে এসে তার  ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকার চামড়া ৩শ’ টাকার বেশি দাম পাচ্ছেন না।  

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। কয়েক বছর ধরে চামড়ার দাম না পেয়ে এ বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্যবসা ছাড়ার। শুধু সানাই বিশ্বাসই নন, এমন অবস্থা প্রায় সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। তবে চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামেই কেনাবেচা হচ্ছে চামড়া। ফলে ব্যবসায়ীদের লোকসান হওয়ার কোনো সুযোগ নাই।  

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তম চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাটে ঈদ পরবর্তী দ্বিতীয় হাট বসে শনিবার। এদিন অন্তত ২ কোটি টাকার চামড়া নগদ বেচাকেনা হয়েছে, দাবি- ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুলের। এদিন ট্যানারি প্রতিনিধি ও বাইরের ব্যাপারীদের সমাগম এবং চামড়ার আমদানি বেশি থাকলেও দাম নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই।  

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চামড়া নিয়ে খেলছে ট্যানারি মালিকরা। তারা দিনের পর দিন বকেয়া পরিশোধ না করে টালবাহানা করছেন। এতে মৌসুমি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। মোকামে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানালেও ট্যানারি মালিকদের রোষানলে পড়ার ভয়ে অনেকেই সাংবাদিকের কাছে কথা বলতে চাননি।    

শনিবার সরেজমিনে ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোর-খুলনা মহাসড়কের রাজারহাট এলাকায় এ চামড়ার মোকাম। দেশের অন্যতম বৃহত্তম চামড়ার মোকাম যশোরের এই হাটে প্রায় ৩শ’ আড়ত রয়েছে। এ হাট বসে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার। যশোর ছাড়াও আশেপাশের জেলাগুলো থেকে ব্যবসায়ীরা এ হাটে চামড়া নিয়ে আসেন।  

কোরবানি ঈদ ঘিরে প্রতিবারই রাজারহাটে ১৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়। কিন্তু গত শনিবার ঈদ-পরবর্তী প্রথম হাটে বৃষ্টির কারণে চামড়া নিয়ে আসতে পারেননি ব্যাপারিরা। ফলে সীমিত পরিসরে হাট জমলেও গত হাটে অর্ধকোটি টাকারও চামড়া বেচাকেনা করতে পারেনি। তবে শনিবার রাজারহাট চামড়ার হাটের চিত্র ছিল ভিন্ন। এদিন হাটে চামড়ার সরবরাহ ছিল আশাব্যঞ্জক। অনেক ব্যবসায়ী হাটে চামড়া রাখার জায়গা পর্যন্ত পাননি। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই রাস্তার ওপর চামড়া নিয়ে বসেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে বাড়তে থাকে ভিড়। ট্যানারি শিল্পে দেওয়ার জন্য স্থানীয় আড়তদারেরা চামড়া কিনে মজুত করেন। এদিন হাটে ভালো চামড়া উঠলেও দাম নিয়ে সন্তুষ্টি নন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীররা। প্রতি পিচ গরুর চামড়া মানভেদে ১শ’ থেকে ৭শ’ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ২০ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে।  

ব্যবসায়ীরা জানান, ঋণ নিয়ে চামড়া ক্রয় করেছেন তারা। কিন্তু বাজারে সরকার নির্ধারিত দাম না পেলে আসল তো দূরের কথা, লবণ খরচও উঠবে না তাদের।    

এদিন হাটে চামড়া বিক্রি করতে আসা যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার চামড়ার ব্যবসায়ী সুনীল ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, গতহাটে ১শ’ পিচ চামড়া আনলেও বাইরের ব্যবসায়ী ও হাট না জমায় চামড়া বিক্রি করিনি। শনিবার হাট জমলেও চামড়ার ঠিক দাম পাচ্ছি না।  

তিনি আরো বলেন, প্রতিপিচ ছাগলের চামড়া ১০ থেকে ১৫ টাকা দরে কিনেছি। এরপর লবণ ও পরিবহন মিলে চামড়া প্রতি খরচ হয়েছে তার ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এখন হাটে ২০ টাকার বেশি দাম উঠছে না। লাভ হওয়া দূরে থাক, লবণের দামই উঠছে না। পুঁজিতেই টান পড়ছে তার।

অভয়নগরের সেলিম হোসেন নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, এবার চামড়ার দাম নিয়ে ভয় থাকায় অনেক হিসাব করে চামড়া কিনেছি। তিনি ২শ’ পিস গরু ও ১শ’ পিস ছাগলের চামড়া নিয়ে এসেছেন। ছাগলের চামড়া ৩০ টাকার আর গরু চামড়া ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকার বেশি দাম উঠছে না। অথচ ছাগলের চামড়া কেনা পড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা পিচ আর গরু ৩ শ’ থেকে ৪শ’ টাকা পিচ। পাইকারদের দামে চামড়া বিক্রি করলে লবণের খরচও উঠবে না।

যশোরের রাজার হাটে চামড়া নিয়ে আসা মাগুরা জেলার রানা হোসেন। এ সময় তিনি জানান, লাগাতার কয়েকবছর ধরে চামড়ার দাম না পেয়ে এ বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্যবসা ছাড়ার। কারণ হিসাবে তিনি জানিয়েছেন, ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধ না করায় সর্বশান্ত হয়েছেন তিনি। লাভের আশায় এবারও চামড়া ক্রয় করছেন। তবে ট্যানারি মালিকরা দাম না বাড়ালে এবারও ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তিনি।  

তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দিয়ে চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকরা খেলা করছেন। তাদের কারণে চামড়া বাজারে অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকরা সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা পাচ্ছেন, ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। অথচ চামড়া কিনছেন বাকিতে। কোটি কোটি টাকা বাকিও ফেলে রাখছেন বছরের পর বছর। গত দুই বছরে তিনি ঢাকার ট্যানারি মালিকের কাছে ৩৮ লক্ষ টাকা বকেয়া রেখেছেন। এই টাকাগুলো পেলেই কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারতেন বলে তিনি মনে করেন।  

ঢাকার হেমায়েতপুর চামড়ার ব্যবসায়ী মেসার্স হালিম অ্যান্ড সন্সের স্বত্ত্বাধিকারী হাজী হালিম বাংলানিউজকে বলেন, গেল বছরের তুলনায় এ বছর প্রতি চামড়ায় ২শ’ টাকা বেশি। গ্রেড অনুযায়ী চামড়ার দাম নির্ধারণ হয়। সেহেতু যে চামড়ার যেমন দাম তেমনি পাবেন তারা। এতে তাদের লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা নাই।  
রাজার হাট চামড়ার হাটের ইজাদার হাসানুজ্জামান হাসু বাংলানিউজকে বলেন, সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে এই হাটে। তবে ঈদের আগে ব্যবসায়ীরা বকেয়া টাকা পেলে বেচাকেনা আরও ভালো হতো।  

যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল বাংলানিউজকে বলেন, কোরবানি ঈদ-পরবর্তী প্রথম হাটে রাজারহাটে প্রায় চামড়ার হাট না জমলেও দ্বিতীয় হাট জমেছে। এদিন প্রায় ২ কোটির টাকার বেশি চামড়া বিক্রি হয়েছে। সরকারি নির্ধারিত দামেই কেনাবেচা হচ্ছে এ হাটে। ফলে ব্যবসায়ীদের লোকসান হওয়ার কোনো সুযোগ নাই।

যশোর জেলা বিপণন কর্মকতা সুজাত হোসেন খান বাংলানিউজকে বলেন, সরকার বেঁধে দেওয়া দামেই এই হাটে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে। তাছাড়া চামড়া পাচার হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই ।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০২০ 
ইউজি/ওএফবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।