ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘ঠিক আছে, শেষ কইরা দিতাছি’

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০২০
‘ঠিক আছে, শেষ কইরা দিতাছি’

ঢাকা: বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে শুরুতেই মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন পরিদর্শক লিয়াকত আলী। অকথ্য ভাষায় গালাগালির পর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের পরামর্শে সিনহার ওপর গুলি চালান তিনি।

ওসি প্রদীপের সঙ্গে মোবাইল ফোনে এর আগে লিয়াকত বলেন ‘ঠিক আছে, শেষ কইরা দিতাছি’।

পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলার এজাহারে এমনটাই উল্লেখ করেন নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া। তিনি দাবি করেন, সিনহার মৃত্যুর পরও শরীর-মুখে কয়েকটি লাথি মারেন ওসি প্রদীপ। চেহারা বিকৃত করতে ওসি তার পায়ের বুট দিয়ে মুখে আঘাত করেন।

গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে ডকুমেন্টারি ভিডিওচিত্র শুটের পর টেকনাফ থেকে কক্সবাজারে ফেরার পথে বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর ৫ আগস্ট আদালতের নির্দেশে টেকনাফ থানায় পরিদর্শক লিয়াকত আলী (৩১) ও প্রত্যাহার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া। এরপর গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত ৯ জন আসামিকে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ পুলিশ।

মামলার বাদি ও সিনহার বড় বোন শারমিন বাংলানিউজকে বলেন, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের নির্দেশেই সিনহাকে গুলি করেন পরিদর্শক লিয়াকত। খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবেই এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন আসামিরা। হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে মাদকদ্রব্য ও সরকারি কাজে বাধা বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগ তোলেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষী ও স্থানীয়দের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।  

এজাহারে উল্লেখ করা হয়- মেজর (অব.) সিনহা স্বাভাবিকভাবে দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে বের হন। লিয়াকত ক্ষেপে আরও গালি দিতে দিতে বলেন- ‘তোর মতো বহু মেজর আমি দেখছি, এইবার খেলা দেখামু’। একটু পাশে গিয়ে লিয়াকত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে কল করেন, পরামর্শ করেন। কথোপকথনের একপর্যায় লিয়াকত মোবাইলে ওসিকে বলে- ‘ঠিক আছে, শেষ কইরা দিতাছি’। ফোন রাখার পরই নিজের পিস্তল দিয়ে সিনহাকে কয়েক রাউন্ড গুলি করেন। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।  

জীবন বাঁচাতে ঘটনাস্থল থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে কনস্টেবল সাফানুল করিম ও মো. মোস্তফা তাকে মাটির সঙ্গে শক্তভাবে চেপে ধরেন। এরপর মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে লিয়াকত আরও এক রাউন্ড গুলি চালান। হত্যার পরপরই ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনাস্থলে এসে মেজর (অব.) সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকটি লাথি দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।  

মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের ডকুমেন্টারি ফিল্মের প্রোডাকশন টিমে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্ট্যাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সাহেদুল ইসলাম সিফাত, শিপ্রা রানী দেবনাথ এবং ফাইনাল বর্ষের শিক্ষার্থী তাহসিন রিফাত নূর। মেজর (অব.) সিনহা হত্যার পর পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দু’টি মিথ্যা মামলাটি দায়ের করে। সিফাত ও শিপ্রার নামে মাদকদ্রব্যসহ দু’টি মামলায় আসামি করা হয়। তবে তাহসিন রিফাতকে মুচলেখা রেখে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী সিফাতের মামা মাসুম বিল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমে সিফাত ও শিপ্রার জামিন আবেদনে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হেয়ারিং করা হয়। সব সার্টিফায়েড কাগজপত্রের জন্য আবেদন করেছি। কাগজগুলো এলেই আমরা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ওদের জামিনের জন্য আবারও আবেদন করবো। সিফাত ও শিপ্রার সঙ্গে এখনও দেখা করতে পারিনি। শুধু কথা হয়েছে। সিফাতকে আবার পুলিশের দায়ের করা মামলার এজাহারে ৩০২ ধারায় আসামি রেখেছে।

তিনি বলেন, সিফাতের ল্যাপটপ, হার্ডডিক্স, ঘড়ি ও জুতা পাওয়া যায়নি। শুধু আইফোন ও ক্যামেরা পাওয়া গেছে। সেগুলো জব্দ তালিকায়ও দেখায়নি পুলিশ।

আদালতে সাত আসামির আত্মসমর্পণ:
গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত ৯ আসামির মধ্যে সাত আসামী ৬ আগস্ট বিকেলে কক্সবাজার আদালতে আত্মসমর্পণ করে। মামলা এজাহারভুক্ত ১ নম্বর আসামি বাহারছড়া চেকপোস্টের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও ২ নম্বর আসামি প্রত্যাহার টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন, এএস আই লিটন মিয়া। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত এসআই টুটুল, কনস্টেবল মো. মোস্তফা এখনও আত্মসমর্পণ করেননি। এদিকে আত্মসমর্পণ করা ৭ আসামির ৭ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বর্তমানে তারা কারাগারে।  

এ বিষয়ে র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্নেল আশি বিল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, আদালতের নির্দেশে আসামিরা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। রোববার (৯ আগস্ট) থেকে রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। আপাতত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০২০
এসজেএ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।