ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ঋণেও প্রতারণা সাহেদের, রাষ্ট্রীয় কাজের অজুহাত

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২০
ঋণেও প্রতারণা সাহেদের, রাষ্ট্রীয় কাজের অজুহাত

ঢাকা: হাসপাতাল জালিয়াতি এবং করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট ও সার্টিফিকেট দিয়ে রোগীদের কাছ থেকে বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেই দুর্নীতি থেমে যায়নি রিজেন্ট গ্রুপ চেয়ারম্যান ও রিজেন্ট হাসপাতাল মালিক সাহেদ করিমের। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরেও তার প্রতারণার তথ্য-প্রমাণ মিলেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা ঋণ পরিশোধের তাগিদ দিতে তার সঙ্গে কোনো দিন দেখাই করতে পারতেন না। তার অফিসে গেলেই বলা হত, তিনি বিদেশে আছেন।

অথবা রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন। এখন তাকে পাবেন না। পরে আসতে হবে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পর এমন সব প্রতারণাও করতেন ফেরারি সাহেদ করিম।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে রিজেন্ট হাসপাতালের ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং স্ক্যানার (এমআরআই) যন্ত্র কেনার নাম করে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) ঋণ আবেদন করেছিলেন সাহেদ। এরপর ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা ঋণ নেন সাহেদ। গত সাড়ে পাঁচ বছরে (২০১৫- ২০২০ জুলাই পর্যন্ত) এই ঋণের একটি টাকাও ফারমার্স ব্যাংককে পরিশোধ করেনি মহাপ্রতারক সাহেদ করিম ওরফে সাহেদ।

ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় ২০১৭ সালের শেষে ফারমার্স ব্যাংকের পক্ষ থেকে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছিল। তবে কিছুদিন পরে প্রতারক সাহেদ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়ে নেন। তবুও ব্যাংক ঋণের একটি টাকাও পরিশোধ করেননি। বর্তমানে সাহেদ কমিরের কাছে ফারমার্স ব্যাংক ঋণ বাবদ দুই কোটি ৭৩ লাখ টাকা পায়।

পদ্মা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, রিজেন্ট হাসপাতালের জন্য এমআরআই যন্ত্র কেনার জন্য ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সাহেদ করিম ব্যাংকে ঋণের আবেদন করেছিললেন। পরে এই ঋণটি তৎকালীন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতি তার সরাসরি ক্ষমতা বলে অনুমোদন করেছিলেন। তখন ব্যাংকের কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। এরপরও ব্যাংক তার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সাহেদ করিমের সঙ্গে কোনো দিনও দেখা করতে পারেননি কর্মকর্তারা। সবসময় রিজেন্ট গ্রুপের হিসাব শাখার লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো।

এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের গুলশান শাখার ম্যানেজার সাব্বির মো. সায়েম বাংলানিউজকে বলেন, ঋণ নেওয়ার পর থেকে তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েন! কখনও তার সঙ্গে দেখা করা যেত না। সাহেদ করিমের কাছে মোট দুই কোটি ৭৩ লাখ টাকা এখনও পায় ব্যাংক।

তিনি বলেন, ২০১৭ সালে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়েরের পরও আমার বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখনই যেতাম, তখনই তিনি বিদেশে থাকতেন! অথবা রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজে ব্যস্ত! এই কথাগুলো তার সহযোগীরা বলতেন। এরপর আমরা ২০১৯ সালে অর্থ-ঋণ আদালতে তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেছি।

দ্রুত বিচারের দাবি:
করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ সার্টিফিকেট জালিয়াতির অন্যতম হোতা সাহেদ আলম ও ডা. সাবরিনার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধীদের দ্রুত বিচার আদালতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে একাত্তরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জেকেজির সাবরিনাকে দ্রুত গ্রেফতার করা হলেও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমকে এখনও ধরা হয়নি। আমরা এ দুর্বৃত্তের দ্রুত গ্রেফতার দাবি করছি। এছাড়াও সাহেদ করিমের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের দ্রুত বিচার আদালতে বিচারের দাবি জানায় এই কমিটি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান:
সাহেদের দুর্নীতির অনুসন্ধানে তথ্য চেয়ে নয়টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক, উত্তর সিটি করপোরেশন, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর, উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের উত্তরা শাখার ব্যবস্থাপক, দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের বিমানবন্দর শাখা ব্যবস্থাপক, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এবং এনবিআরের কর অঞ্চল-৯ এর উপ-কর কমিশনার।

দুদক সূত্র জানায়, ক্ষদ্র ঋণ ও এমএলএম ব্যবসার নামে জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে পরস্পর যোগসাজশে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া নাম-পরিচয়ে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ, আয়কর ফাঁকির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এই অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছে সংস্থাটি।

গত ৬ জুলাই নানা অনিয়ম, প্রতারণা, সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ, করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, সার্টিফিকেট দেওয়া ও রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপের দুটি হাসপাতালে অভিযান চালান র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানের নেতৃত্ব দেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম। অভিযানে গিয়ে প্রতারণার সত্যতা মেলে, সেইসঙ্গে পাওয়া যায় গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক তথ্য।

পরদিন গত ৭ জুলাই রিজেন্ট গ্রুপের মূল কার্যালয় এবং রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরের দুটি হাসপাতাল সিলগালা করে দেওয়া হয়। হাসপাতালটি প্রতারণা করে ১০ হাজারেরও বেশি করোনা পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়েছে। এছাড়া অভিযানের সময় রিজেন্ট হাসপাতালের পরিচালক ও ব্যবস্থাপকসহ আটজনকে আটক করেছে র‌্যাব। তবে মূলহোতা সাহেদ এখনও ধরা পড়েননি।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩২ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২০
এসজেএ/টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।