ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সদরঘাটে লঞ্চ দুর্ঘটনা: জামিনযোগ্য মামলা, আসামিও অধরা 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৪ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০২০
সদরঘাটে লঞ্চ দুর্ঘটনা: জামিনযোগ্য মামলা, আসামিও অধরা 

ঢাকা: বুড়িগঙ্গা নদীতে মর্নিং বার্ড লঞ্চ দুর্ঘটনায় নৌ-পুলিশের পক্ষ থেকে যে মামলাটি করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটি অভিযোগই জামিনযোগ্য। মামলা হওয়ার এক সপ্তাহ কেটে গেলেও কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আইনজীবীরা বলছেন, নৌপথের জন্য কার্যকর ও যুগোপযোগী আইন নেই। সে কারণে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও দুর্বল অভিযোগের ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।

এ মামলার ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে।  

যদিও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, তদন্তে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে এটি হত্যা মামলায়ও রূপান্তর হওয়া সম্ভব।  

পুলিশ বলছে, আসামিদের গ্রেপ্তারে সব ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।  

গত ২৯ জুন সকালে দুর্ঘটনা কবলিত এমএল মর্নিং বার্ড নামের ওই যাত্রীবাহী লঞ্চ মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে সদরঘাটের দিকে আসছিল। শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। দুর্ঘটনার ৩৪ জন জনের মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় গত ৩০ জুন সদরঘাট নৌপুলিশের এসআই শামসুল আলম বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় দুর্ঘটনা কবলিত লঞ্চটিকে ধাক্কা দেওয়া ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদ, মাস্টার আবুল বাশার, মাস্টার জাকির হোসেন, স্টাফ শিপন হাওলাদার, শাকিল হোসেন, হৃদয় ও সুকানি নাসির মৃধার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও পাঁচ-সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটি তদন্তে আগামী ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন্নাহার।  

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ময়ূর-২ লঞ্চটি পেছন দিকে বেপরোয়াভাবে ছোট আকারের মর্নিং বার্ড লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়।  

সদরঘাটের একটি সিসি ক্যামেরাতেও দুর্ঘটনার চিত্র পাওয়া গেছে।  

এজাহারে বলা হয়েছে, শ্যামবাজার বরাবর ফরাশগঞ্জ ঘাট সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পার্শ্বে ২৯ জুন সকাল ৯টা ১৩ মিনিটে মর্নিং বার্ড লঞ্চকে ময়ূর-০২ লঞ্চটি দ্রুত বেপরোয়াভাবে ধাক্কা মারে। ফলে মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ঘটনাস্থলে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীসহ পানিতে ডুবে যায়। ডুবে গিয়ে অনুমান ৮৫ লাখ টাকা ক্ষতি সাধন করে।

এরপর দুর্ঘটনায় নিহতদের বিবরণ উল্লেখ করা হয়। সবশেষ আসামিদের নাম পরিচয় উল্লেখ করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, দায়িত্বে অবহেলা ও বেপরোয়াভাবে মর্নিং বার্ড লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিয়ে অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটায় এবং লঞ্চটির ধ্বংস সাধন করে বাংলাদেশ পেনাল কোডের ২৮০, ৩০৪ (ক), ৩৩৭ ও ৩৪ ধারায় অপরাধ করেছে। আসামিরা শত্রুতামূলকভাবে পূর্বপরিকল্পনামাফিক এই প্রাণহানি ঘটিয়েছে কিনা তা নিবিড়ভাবে তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।  

মামলার অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে যে শাস্তি হবে:  
৩০৪ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, বেপরোয়া বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কার্য করে যদি কোনো ব্যক্তি মৃত্যু ঘটায়, তার পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

২৮০ ধারায় বলা হয়েছে, বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কোনো জাহাজ চালানো, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন বা জখম করার আশঙ্কা থাকলে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে।

৩৩৭ ধারায় বলা হয়েছে, বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্য সহকারে কোন কাজ করে মানুষের জীবন বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫ শ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

দুর্ঘটনার পর সদরঘাটের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, পেছনে চলতে থাকা ময়ূর-২ এর ধাক্কায় ছোট আকারের মর্নিং বার্ড মুহূর্তের মধ্যে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যায়।

এতো ব্যাপক প্রাণহানির পরও আইনের অপ্রতুলতার কারণে দুর্বল অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মামলায় এখন আসামি ধরা পড়লেও তাদের খুব সহজেই জামিনে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

ঢাকার আদালতের ফৌজদারী আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, যে আইনে মামলাটি দায়ের হয়েছে তা ১৮৬০ সালে ব্রিটিশদের করা। এখন অপরাধের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরাধের ধরনও অনেক পাল্টেছে। এ অবস্থায় সড়ক পরিবহনের জন্য ২০১৮ সালে একটি আইন হয়েছে। কিন্তু নৌ-পথের জন্য একটি কার্যকর ও যুগোপযোগী আইন নেই। সেরকম কোনো আইন হলে অপরাধীরা শাস্তির আওতায় আসতো।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন অবশ্য মনে করেন, এখানে সুশাসনের অভাবটাই মুখ্য। তিনি বলেন, এখন অনেক লঞ্চ মালিক পরিবহন মালিকরা সংসদ সদস্য পর্যন্ত হচ্ছেন। অনেকে খুবই প্রভাবশালী। দেশে সুশাসন নিশ্চিত না করে যতো আইনই করা হোক এ ধরনের অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব না।

তবে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল মাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল মনে করেন, অভিযোগ যদি আরও গুরুতর প্রমাণিত হয়, তখন তদন্তে অভিযোগ পরিবর্তন হতে পারে।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মামলাটি মাত্র রুজু হয়েছে। এখনই শেষ কথা বলার সময় আসেনি। রানা প্লাজার ঘটনায়ও প্রথম অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা হয়েছিল। পরে কিন্তু তদন্তের পর সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। তাই এই মামলাতেও প্রাথমিকভাবে ৩০৪ (ক) ধারায় অভিযোগ আনা হলেও তদন্তে গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হলেও অভিযোগটি ৩০২ ধারাতেও রূপান্তরিত হতে পারে।

এদিকে মামলা দায়েরের পর সাত দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলাটি তদন্ত করছেন নৌ-পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহিদুল আলম। জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। আসামিদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। তবে তারা ফোন নম্বরগুলোও ব্যবহার করছে না। তাই তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০২০
কেআই/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।