ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

'রেজাল্ট দিয়ে কি হবে? আমার বাবাই তো আর নাই।’

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৩ ঘণ্টা, জুন ১, ২০২০
'রেজাল্ট দিয়ে কি হবে? আমার বাবাই তো আর নাই।’

পাথরঘাটা (বরগুনা): স্বপ্ন সবাই দেখেন। ছোট-বড়, ধনী-গরীব সব মানুষই স্বপ্ন নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান। স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই। তাইতো একমাত্র ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন বরগুনার চরকলোনী এলাকার দরিদ্র ফিরোজা বেগম। অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে আর স্বামী দেলোয়ার হোসেন রিক্সা চালিয়ে একমাত্র ছেলে হৃদয়কে লেখাপড়া করাতেন। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের শিকার হন হৃদয়। আর তাই একমাত্র ছেলের ফলাফল পাওয়ার পর কান্না জড়িত কন্ঠে রিকশা চালক দেলোয়ার হোসেন বলেন ‘রেজাল্ট দিয়ে কি হবে? আমার বাবাই তো আর নাই।’

একেতো একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোক। তার উপরে সেই হারানো সন্তানের এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের খবর! সব মিলিয়ে পাথর বনে গেছেন নিহত হৃদয়ের মা ফিরোজা বেগম।

চোখের পানি যেন থামছেই না। ছেলে হারানোর শোক, তারপরে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন বুনার ফলাফল পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মা ফিরোজ বেগম ও বাবা দেলোয়ার। এখন বাবা-মায়ের নির্বাক তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। ছেলে হারানোর শোক আর এসএসসির ভালো ফলাফল নিয়েই থাকতে হবে তাদের। সদ্য প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে জিপিএ ৪.১১ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন হৃদয়। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে হৃদয়কে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন এক ধাপ এগিয়ে গেলেও সেই স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে ফিরোজা বেগমের।

ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নে বিভোর এই দম্পত্তি তাদের ছেলে মো. সুজন মিয়া হৃদয়কে ভর্তি করেছিলেন বরগুনার টেক্সটাইল অ্যান্ড ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে। দুষ্টুমিতে পটু হৃদয় লেখাপড়ায় একেবারে খারাপ ছিলো না। কিন্তু সব আশা পরিণত হয়েছে নিরাশায়। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজ স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন বাবা-মা।  

হৃদয়ের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল জানতে পেরে কান্না জড়িত কন্ঠে ফিরোজা বেগম বলেন, ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর ইচ্ছা ছিলো। আমাদের মতো যাতে কষ্ট করতে না হয়, এজন্য হৃদয়কে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার সব শেষ করে দিলো ওরা। এসময় হৃদয়ের বাবা দেলোয়ার হোসেন বলেন, রেজাল্ট দিয়ে কি হবে? আমার বাবাই তো আর নাই।

এর আগে ঈদুল ফিতরের দিন সোমবার (২৫ মে) বিকেলে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের গোলবুনিয়া এলাকায় পায়রা নদীর তীরে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বেড়াতে যান হৃদয়। এ সময় পূর্বশত্রুতার জেরে এবং হৃদয়ের সঙ্গে থাকা এক বান্ধবীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় হৃদয়সহ তার কয়েক বন্ধুকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে স্থানীয় কয়েকজন যুবক-কিশোর। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসকরা হৃদয়ের সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার (২৬ মে) সকালে মারা যান হৃদয়।

ফিরোজা বেগমের প্রতিবেশী জালাল আহমেদ বলেন, একেতো দরিদ্র পরিবার, তার মধ্যে একটি সন্তানকে জন্মদান থেকে শুরু করে ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত লালন-পালন এবং লেখাপড়া করানোর পিছনে যে সময়, শ্রম, অর্থ এবং আদর স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়েছেন, মুহূর্তেই তা ধুলোয় মিশে গেছে কিছু বিপথগামী ছেলেপেলের কারণে।

এসময় তিনি হৃদয় হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, ফিরোজা বেগম তার একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছেন। কোন বাবা-মা তার সন্তান হারানোর বেদনা কখনো ভুলতে পারেন না। ফিরোজা বেগমের কান্না দেখলে আমাদেরও কান্না আসে। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আমরা নির্বাক।

বরগুনার টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, হৃদয় ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিলো না, আবার খুব খারাপও ছিলো না। আমাদের প্রত্যাশা ছিলো হৃদয় এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪ পেতে পারে। আমাদের ধারণাই সঠিক হয়েছে। হৃদয় জিপিএ ৪.১১ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ভালো ফলাফল করার পরও হৃদয়ের জন্য আজ আমাদের অশ্রু ঝরছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এ খারাপ লাগাটা বলে বোঝাতে পারবো না। এসময় তিনি হৃদয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

এ বিষয়ে বরগুনা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. শাহজাহান হোসেন বলেন, হৃদয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১৪-১৫ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলার প্রধান আসামিসহ ইতোমধ্যেই আমরা সাত আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার সাত আসামির মধ্যে ইতোমধ্যে আদালত তিনজন আসামির পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আমরা তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এছাড়া বাকি আসামিদের ধরতে পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫২ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০২০
এমআরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।