ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘করোনা উন্নয়ন-অর্থনীতির গল্পের দুর্বলতা উন্মোচন করেছে’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৪ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২০
‘করোনা উন্নয়ন-অর্থনীতির গল্পের দুর্বলতা উন্মোচন করেছে’

ঢাকা: করোনা ভাইরাস দেশের উন্নয়নের গল্প ও অর্থনীতির দুর্বলতা কোথায়, তা উম্মোচন করে দিয়েছে বলে বাম গণতান্ত্রিক জোট আয়োজিত এক অনলাইন মতবিনিময় সভায় জানিয়েছেন আলোচকরা।

শনিবার (৩০ মে) ‘করোনাকালের অর্থনীতি-করোনাত্তোর অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং আগামী বাজেটে অগ্রাধিকার খাত কী হওয়া উচিত’ শীর্ষক ওই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।  

সভায় আলোচকরা বলেন, এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয় করোনা সংক্রমণ শুধু স্বাস্থ্যখাতে আমাদের রাষ্ট্রের অবহেলা ও মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরেছে তা নয়, উন্মোচন করেছে উন্নয়নের গল্প ও অর্থনীতির দুর্বলতা কোথায়।

আমাদের অর্থনীতি যে ৪টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে- রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, করোনা সংক্রমণের কালে এর প্রতিটিই সংকটের মুখে। রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আয় করে যে খাত, সেই গার্মেন্টস খাতের নড়বড়ে চেহারা আর মালিকদের দায় না নেবার মানসিকতা থেকে এটা পরিষ্কার, প্রণোদনা, মুনাফা আর শ্রম শোষণের মধ্য দিয়ে বিকশিত এ খাত অর্থনৈতিক দুর্যোগে কতটা সুযোগ সন্ধানী। ৪০ বছরের শিল্প মাত্র ৩ মাসে এতটাই কাহিল হয়ে পড়েছে যে, রাষ্ট্রের প্রণোদনা ছাড়া সে উঠে দাঁড়াতে পারছে না।

কৃষিখাতের গুরুত্ব তুলে ধরে আলোচকরা বলেন, করোনায় দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে সবচেয়ে উপেক্ষিত খাত, বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক। শুধু ভাতের সংস্থান করা নয়, সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস, ফল কোনো কিছুরই অভাব বোধ করতে দেয়নি যে খাত, গত বাজেটেও সবচেয়ে উপেক্ষিত ছিল তা। মাত্র ৩.৫ শতাংশ বরাদ্দ এ খাতে। এছাড়া দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। দেশের অর্থনৈতিক আয়তনের ৫০ শতাংশ সরবরাহ করে এই খাতের শ্রমজীবীরা। কাজ নাই তো তাদের মজুরি নাই। গত ৪ মাসে তাদের জীবন কীভাবে কেটেছে তার বর্ণনা দেওয়া কঠিন। ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, আর সব মিলিয়ে চুরিসহ দেড় লাখ টন চাল বরাদ্দ ছিল। ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমশক্তির সাড়ে পাঁচ কোটিই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। তারা আসলে কতটুকু সহায়তা পেয়েছে তার হিসেব বের করা কঠিন।

চিকিৎসাখাতের বেহাল দশা তুলে ধরে বক্তারা বলেন, বহু বছর ধরে চিকিৎসা খাতে বাজেট বরাদ্দ ৫ শতাংশের নিচে, জিডিপির হিসেবে ১ শতাংশের কম ০.৯ শতাংশ, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। নিজের টাকায় চিকিৎসার খরচ নির্বাহ করার দিক থেকে বাংলাদেশের জনগণ সর্বোচ্চ খরচ করে। করোনায় কেন মানুষ টেস্ট করতে চায় না, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একজনের টেস্ট করাতে সব মিলিয়ে ৫ হাজার টাকা এবং হয়রানির কথা এবং মাসিক আয়ের কথা তুলনামূলকভাবে আলোচনা করলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়।   

প্রবাসী আয়েও করোনার কালে বড় ধাক্কা আসবে উল্লেখ করে সভায় বলা হয়, এর ফলে রেমিটেন্সও কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে শ্রমিক যাওয়া বাবদ খরচ অন্য দেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা নগণ্য, রিক্রুটিং এজেন্সির নামে আদম ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া প্রভাব। এতো কিছুর পরও প্রতিবছর গড়ে ৮ লাখ যুবক-যুবতী কাজের সন্ধানে দেশের বাইরে যেত, করোনা পরিস্থিতিতে সেটা কমবে। একই সঙ্গে ফিরে আসা শ্রমিকের সংখ্যা বাড়বে। ১ কোটির বেশি প্রবাসী শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফেরত আসবে। করোনা বিপর্যয় সামাল দিতে সরকার যে লক্ষাধিক কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সামগ্রীক অর্থনীতির ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণের বিষয়গুলো সেখানে তেমন গুরুত্ব পায়নি, যতটা গুরুত্ব পেয়েছে বড় ও মাঝারি শিল্প এবং ব্যবসা খাত।   

‘চলমান করোনা সংকটের মধ্যেই আগামী ১১ জুন আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট আসছে। বাজেটে কে গুরুত্ব পাবে, আর কে গুরুত্ব হারাবে, তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা। বিগত বছরগুলোতে ঋণখেলাপি, ব্যাংকডাকাত, টাকা পাচারকারীরা সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। এবারের বাজেটেও কী সেই ধারা অব্যাহত থাকবে? বাজেটের প্রাক্কালে এ প্রশ্ন খুবই সঙ্গত। ’   

মতবিনিময় সভায় করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, সবার খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, সামাজিক নিরাপত্তা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি কৃষিতে জিডিপি’র ১২ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৩ শতাংশ, শিক্ষা খাতে জিডিপির ৮ শতাংশ, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ দ্বিগুণ করার দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতির দাবি জানানো হয়।
 
সভায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ৪০ শতাংশ কর্তনের নিন্দা জানিয়ে তা বাতিল এবং রাষ্ট্রপ্রতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ৪০ শতাংশ কর্তন, আগামী বাজেটে সরকারি অপচয় কমানো, ব্যয়বহুল রূপপুর প্রকল্পসহ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধ রাখা, বিশেষ করে জ্বালানি খাতে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করে তা বন্ধ করা এবং মুক্তবাজারী অর্থনীতি পরিহার করে জনকল্যাণের অর্থনীতির নিয়ম মেনে আগামী বাজেট প্রণয়ন ও অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়।
 
বাম জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশিদ ফিরোজের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে আলোচনা করেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ্ উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এম. এম. আকাশ, সিপিডি’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলপমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন্দ নিলোর্মী ডালিয়া, কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, বাসদ’র (মার্কসবাদী) নেতা আলমগীর হোসেন দুলাল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পদক মোশরেফা মিশু, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩২ ঘন্টা, মে ৩০, ২০২০
আরকেআর/এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।