ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘আলোচিত অপরাধ’ নেই, সার্বিকভাবে কমেছে সামান্যই

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০২০
‘আলোচিত অপরাধ’ নেই, সার্বিকভাবে কমেছে সামান্যই

ঢাকা: করেনা ভাইরাসের সংক্রমন প্রতিরোধে কার্যত অঘোষিত ‘লকডাউন’ পরিস্থিতি বিরাজমান রাজধানীজুড়ে। সার্বিকভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি বিনা প্রয়োজনে নগরবাসীকে বাইরে বের না হতে আহ্বান জানাচ্ছে প্রশাসন। দীর্ঘ এই ছুটির শুরুতেই লাখ মানুষ শহর ছেড়ে যাওয়ায় একরকম ফাঁকা হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা।

ফাঁকা ঢাকার সড়কে এবং বাসা-বাড়িতে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও সার্বিকভাবে অপরাধের ঘটনা খানিকটা কমেছে। জরুরি প্রয়োজনে যারাই নির্জন সড়কে নামছেন ‘রাত নামতেই ছিনতাইয়ে আশঙ্কার’ কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ।

তবে করোনা পরিস্থিতিতেই সার্বিকভাবে নজরে থাকা মাসজুড়ে রাজধানীতে আলোচিত অপরাধের ঘটনা নেই।
 
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘমেয়াদে ছুটি এবং করোনা আতঙ্কের কারণে মানুষের চলাফেরা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমসাময়িক সময়ে অপরাধ কমেছে। তবে ফাঁকা ঢাকায় পেশাদার চোর-ছিনতাইকারীদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে।
 
এদিকে, অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ সময়ে যেসব অপরাধীরা ‘ট্রাডিশনাল’ অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তারা এখন কার্যত বেকার। ফলে এখন থেকে তারাও অপরাধের ধরণ পরিবর্তন করে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়বেন। করোনায় সৃষ্ট সংকট দীর্ঘমেয়াদী হলে এই আশঙ্কা ক্রমেই বাড়তে পারে।
 
বুধবার (০১ এপ্রিল) দিনগত মধ্যরাতে রাতে রাজধানীর কলেজগেট এলাকার একটি ওষুধের দোকানে ‘ফিল্মি স্টাইলে’ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। করেনা পরিস্থিতিতে সাধারণ সময়েই লোকসমাগম কম, তার ওপর মধ্যরাতে তিনজন এসে অস্ত্রের মুখে মুহূর্তেই ডাকাতি করে পালিয়ে যায়।
 
বিল্লাহ ফার্মা মানে ওই দেকানের মালিক নাহিদ বিল্লাহর বর্ণনা অনুযায়ী, রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার পর দোকান বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় একটি পিকআপে করে তিনজন এসে সরাসরি দোকানে প্রবেশ করেন। তাদের মুখে মাস্ক, মাথায় গামছা বাঁধা ছিলো এবং দুইজনের হাতে চাপাতি ও একজনের হাতে রড ছিলো। তখন উপস্থিত একজন ক্রেতাসহ, দোকানীকে চাপাতির মুখে দোকানের ক্যাশ থেকে টাকা এবং ল্যাপটপ লুট করে নেয়। মাত্র ২ মিটেরও কম সময়ের মধ্যে ডাকাতি করে পিকআপে করে পালিয়ে যান ওই তিনজন, যাদের কেউ ধরা পড়েনি।
 
গত ২৮ মার্চ দিনগত রাতে রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকায় একটি বাসায় গ্রিল কেটে স্বর্ণালঙ্কার চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। চারতলা ওই ভবনেরর বাসিন্দারা তখন ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
 
২৬ মার্চ রাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার ফটো এডিটর সাহাদাত পারভেজ। পরে সেখান থেকে তিনি কৌশলে বের হয়ে আসেন। নির্জন রাতের ঢাকায় সবাইকে সাবধানতার সঙ্গে চলাফেরার অনুরোধ জানান তিনি।
 
এর আগে গত ২২ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও থানা এলাকায় একটি বাসায় ল্যাপটপ চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এক চোর গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর একটি শপিংমল থেকে থেকে আরও চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় ৯৩টি চোরাই ল্যাপটপ উদ্ধার করে তেঁজগাও থানা পুলিশ।
 
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক অপরাধ তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে ঢাকায় ঢাকার ৫০টি থানায় দায়েরকৃত মামলা অনুযায়ী বিগত ২ মাসের তুলনায় অপরাধ কিছুটা কমেছে। তবে উদ্বেগের বিষয়, গত ২ মাসের তুলনায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে।
 
মার্চ মাসে ডিএমপিতে সর্বমোট মামলা দায়ের করা হয়েছে ২ হাজার ৫৫টি। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনায় ২টি, বাসায় চুরির ঘটনায় মামলা ৫১টি, খুনের ঘটনায় ১৭টি, দ্রুত বিচার আইনে ১৪টি, ধর্ষণের ঘটনায় ৫৬টি এবং নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা ১৩২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
 
এছাড়া প্রতারণার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৭টি, মোটরসাইকেল চুরি ১টি ও গাড়ি চুরি ১টি, অন্যান্য চুরির ঘটনায় ১১৭টি, অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে ১৪টি এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১ হাজার ১২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে মার্চ মাসজুড়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি।
 
ফেব্রুয়ারিতে মোট মামলা দায়ের করা হয়েছিল ২ হাজার ১৩১টি। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনায় ৪৫টি, নারী নির্যাতনে ১২০টি, শিশু নির্যাতন ২৯টি, প্রতারণায় ৬১টি, বাসায় চুরির ঘটনা ৭৪টি, মোটরসাইকেল চুরি ১৬, গাড়ি চুরি ১৪, অন্যান্য চুরির ঘটনায় ৮৩টি এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় ফেব্রুয়ারিতে মামলা হয়েছে ১ হাজার ২০৫টি।
 
গত জানুয়ারিতে মোট মামলা দায়ের করা হয়েছে ২ হাজার ২৪৭টি। এর মধ্যে খুনের ঘটনায় ২১টি, ডাকাতিতে ২টি, ধর্ষণে ৪২টি, নারী নির্যাতনের ঘটনায় ৮৬টি, প্রতারণায় ৬১টি, বাসায় চুরি ৬৫টি, মোটরসাইকেল চুরি ৩০, গাড়ি চুরি ৭, অন্যান্য চুরির ঘটনা ঘটেছে ১০১টি, অস্ত্র আইনে ১৩টি এবং মাদকদ্রব্য আইনে ১ হাজার ৩২৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
 
সংশ্লিষ্টরা জানান, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের তৎপরতা থেমে নেই। মাসের শেষের দিকে এসে চুরি-ডাকাতির ঘটনা কমলেও নিত্য নতুন কৌশলে মাদক চোরাকারবারীদের তৎপরতা থেমে নেই। ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত পালানোর সুযোগ এবং ওষুধ-নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার অজুহাতে পিকাপ ভ্যান ও প্রাইভেট কারে মাদকের চালান অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে চক্রগুলো। করোনা প্রতিরোধে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকলেও তাদের নিয়মিত দায়িত্ব হিসেবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোসহ সার্বিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘ছোট-খাট অপরাধ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তারা এখন বিকল্প পথ হিসেবে বাসা-বাড়িতে হানা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ সময়-সুযোগ অনুযায়ী অপরাধের ধরণ পরিবর্তন হয়। দেশজুড়ে চলমান করোনা ভাইরাস সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে এসব চুরি-ছিনতাইয়ের পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ’
 
অভিনব পন্থায় মাদক চোরাচালান প্রসঙ্গে র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার (এসপি) মহিউদ্দীন ফারুকী বলেন, ‘রাস্তা ফাঁকা থাকার সুযোগ নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা অভিনব পন্থায় প্রাইভেটকার-পিকআপে করে মাদকের চালান বহনের চেষ্টা করছেন। এজন্য র‌্যাবের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া সড়কে নিয়মিত চেকপোস্ট স্থাপন করে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতিবিধি সন্দেহজনক হলে গাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ’
 
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মাহবুব আলম জানান, বাসা একেবারে ফাঁকা থাকলে চুরি-ডাকাতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য ডিবির প্রত্যেকটা টিম কাজ করছে। ফাঁকা ঢাকায় সংঘবদ্ধ অপরাধ ঠেকাতে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের পেট্রোলিং বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সার্বিক অপরাধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০২০
পিএম/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।