ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

করোনায় নয়, না খেয়ে মরার আশঙ্কা শ্রমজীবীদের

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩২ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২০
করোনায় নয়, না খেয়ে মরার আশঙ্কা শ্রমজীবীদের বসে আছেন একজন শ্রমিক। ছবি: বাংলানিউজ

সিরাজগঞ্জ: পেটে জামিন দেওয়ার মতো আটার চাপড়ি তৈরি করে সকালে ছেলেমেয়েকে খাওয়ালেও রিকশা শ্রমিক দম্পতি থেকেছেন অভুক্ত। গত রাতের বাসি পান্তাভাত দিয়ে দুপুরটাও পাড়ি দিয়েছেন তারা। ঘরে আধা সের চাল রয়েছে যা দিয়ে আজ রাতে কোনোমতে ছেলেপুলে নিয়ে খাবেন তারা।

সোমবার (৩০ মার্চ) বিকেলে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের চর কল্যানী রিকশা শ্রমিক মিজানুর রহমানের বাড়ির চিত্র ঠিক এমনটাই।

মিজান বলেন, কাজ নেই।

ঘরে যা জমানো ছিল তা দিয়ে ৫ দিন চলেছে। আজও কষ্টেসৃষ্টে চলে যাবে। কিন্তু কাল কি হবে? তা নিয়ে চিন্তায় আছি। সুদের ওপর টাকার জন্য ঘুরছি-এখন পর্যন্ত কারও কাছে টাকা পাইনি। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে করোনা নয়, না খেয়েই মরার আশঙ্কা করছেন তিনি।

পাশের বাড়ির রিকশাচালক বৃদ্ধ আলম সেখ বলেন, এক সপ্তাহ ধরে কাজ নেই। সংসার আর কি করে চলবে। সুদে টাকা ধার এনে আপাতত চলছি। একই গ্রামের রংমিস্ত্রী সবুজ আলীর হাতে কাজ নেই ১০ দিন। টাকার অভাবে সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই কাজের সন্ধানে বেড়িয়েছিলেন তিনি। রাস্তায় পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে বাড়ি ফিরে ঘরের দাওয়ায় হতাশ হয়ে বসে রয়েছেন।

কল্যানী এলাকার সেবিকা বেওয়া (৬০) একটি ক্ষুদ্র বেসরকারি ফ্যাক্টরিতে ঝাড়ুদারের কাজ করে সংসার চালান। কারখানায় কাজ করলে সাতদিন পরপর বিল পান। আটদিন ধরে তার কাজও বন্ধ রয়েছে। তাই বিলও পাননি। অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন বলে জানান স্বামীহারা এই বিধবা নারী।

একই গ্রামের গৃহবধূ খাদিজা খাতুন জানান, তার স্বামী শুভ একজন বাসশ্রমিক। ৫ দিন ধরে বাস বন্ধ থাকা রয়েছে। বিকল্প কোনো আয় নেই তাদের। শিশু সন্তান নিয়ে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে তাদের। সকালে তার স্বামী সুদে টাকা ধার আনার জন্য বেড়িয়েছে। দুপুর গড়িয়ে গেলেও ফেরেনি। টাকা না পেলে চরম বিপাকে পড়বে এ পরিবারটি।

করোনা আতঙ্কে অঘোষিত লকডাউনের ফলে সিরাজগঞ্জের সব শ্রমজীবী পরিবারেই এমন অবস্থা। সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতেই এমন চিত্র দেখা গেছে।

শহরের এম এ মতিন সড়কস্থ ভাসমান চা দোকানদার আব্দুল মোমিন ও বাজার স্টেশন এলাকার ভাসমান চা দোকানী আল-আমিন বলেন, চা বেঁচে দিন ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা আয় হয়। প্রতিদিনের আয়ের টাকা দিয়ে চলে সংসার। আজ ৭দিন ধরে কোনো আয় নেই-কিভাবে যে সংসার চলছে বলে বোঝাতে পারবো না।

শিয়ালকোল ইউনিয়নের শিবনাথপুর গ্রামের নির্মাণ শ্রমিক জহুরুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, দিনমজুর সাইফুল ইসলাম, পশ্চিম মোহনপুরের দুলাল হোসেন, খামার পাইকোশার তাঁত শ্রমিক শহীদুল ইসলাম, সেলিম রেজা ও শাহীন আলমসহ একাধিক শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের একদিকে যেমন কাজ নেই-ঘরে চালও ফুরিয়ে গেছে। এসব শ্রমজীবী মানুষের কাছে এখনো কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি বলে তারা দাবি করেন।

শিয়ালকোল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান শেখ বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার শ্রমজীবী মানুষ রয়েছে। এদের মধ্যে ভাসমান চাস্টল, নির্মাণ শ্রমিক, রংমিস্ত্রি, কৃষি দিনমজুর, মাটিকাটা শ্রমিক রয়েছে। যাদের প্রায় সবাই কাজ বন্ধ। দু’দিন আগে সরকারিভাবে পাওয়া মাত্র সোয়া দুই মেট্রিক টন চাল ও ২৮ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করেছি। যা একেবারেই অপ্রতুল।

কালিয়া হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সবুর বলেন, ৫ হাজারের ওপর শ্রমজীবী মানুষ এখন বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের বিপরীতে মাত্র ২ মেট্রিক টন চাল ও ২০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ হয়েছিল।

কাওয়াকোলা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম ভূঁইয়া বলেন, চরাঞ্চলে কৃষকের ঘরে ফসল থাকলেও তারা বিক্রি করতে পারছেন না। জেলেরা মাছ ধরতে পারছে না। এসব কারণে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে।

সরকারিভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা পেলেও বেসরকারি কোনো সহযোগিতা এখনো পৌঁছেনি বলেও জানান সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে জানান, ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে সাড়ে ৬শ টন চাল ও ১৬ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। এগুলো বিতরণ কার্যক্রম চলছে। এছাড়াও জনপ্রতিনিধিদের কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের একটি তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। ওই তালিকা অনুযায়ী চাহিদাপত্র পাঠানো হবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের এই দুর্যোগ মুহূর্তে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমজীবী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২০
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।