ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

করোনার ছুটিতে বিপর্যস্ত পুরান ঢাকার খেটে খাওয়া মানুষ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২০
করোনার ছুটিতে বিপর্যস্ত পুরান ঢাকার খেটে খাওয়া মানুষ

ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে হুমকির মুখে বিশ্ব অর্থনীতি। অনেকটা থমকে গেছে পুরান ঢাকার খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রাও। এ অবস্থায় পঞ্চমদিনের কর্মহীন সময় কাটাচ্ছেন এসব মানুষ। 

কোথায়ও লোকজনের ভিড় নেই, চলাচলও সীমিত। বাস, নৌযান, কল-কারখানাসহ বন্ধ দোকানপাটও।

নেই হকার, কুলি ও বাসস্টাফদের হাঁক ডাক। চিরচেনা শহর যেন অচেনা! 

করোনার প্রকোপ ঠেকাতে গত বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষকে ১০ দিনের জন্য ঘরে অবস্থান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী নগরবাসী ঘরে অবস্থান করেছেন।  

জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে কেউ বের হচ্ছেন না। তীব্র যানজটের নগরী এখন একদম ফাঁকা ও নীরব নিস্তব্ধ। এতে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছেন দিনমজুরসহ নিম্ন-আয়ের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষেরা।  

সোমবার (৩০ মার্চ) করোনা পরিস্থিতিতে ছুটির পঞ্চমদিনে রাজধানীর পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং খেটে খাওয়া কর্মহীন এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার সদরঘাট, বাংলাবাজার, ইসলামপুর, লক্ষ্মীবাজার, কোটকাচারীর জনসন রোড, ধোলাইখাল রোড, সূত্রাপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মানুষের আনাগোনা একদম কম। করোনার জন্য ব্যবসানির্ভর এসব এলাকাসহ পাড়া মহল্লার দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে। নেই চিরচেনা চায়ের আড্ডাও।  

তবে সকালে দু-একটি দোকান কিছু সময়ের জন্য খোলা রাখা হয়। যাতে এলাকাবাসীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে। দোকানপাট বা বাজারের আশপাশে কিছু মানুষের হঠাৎ দেখা মিললেও তা অন্যান্য সময়ের তুলনায় একেবারেই নগন্য। রাস্তায় গাড়ি বলতে দেখা গেছে ছোট ছোট পিকআপ ভ্যান। তবে তাও সংখ্যায় হাতে-গোনা।  

পুরান ঢাকার বাসিন্দা হারুন দেওয়ান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এলাকায় সকাল থেকে কেউ বাইরে যাচ্ছে না। সবাই বাসায় অবস্থান করেছেন। আমরাও ভাই-বোন সবাই বাসায় অবস্থান করছি। গত পাঁচদিন জরুরি প্রয়োজন যেমন- বাজার করা ছাড়া কেউ বাইরে যাইনি। এছাড়া এলাকার প্রতিটি বাসিন্দা বাসায় অবস্থান করেছেন। আমাদের এলাকা একদম নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে।  

একই কথা রিকশাচালক মো. সোহাগের মুখেও। তবে যাত্রী কমে যাওয়ায় সংসারের খরচ চালাতে যে তার হিমশিম খেতে হয়েছে তা নিয়েও চিন্তিত তিনি।  

করোনার ঝুঁকিতে রাস্তায় বেরিয়েছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তার সোজা উত্তর, পরিস্থিতি যাই অউক (হোক। পেট চালানির লাইগ্যা তো সড়কে নামতেই অইবো।  

‘পয়লা চাইরদিন (চারদিন) বাসায় আছিলাম। সংসার তো ছলে না। খাইয়া বাঁচন লাগবো তো। এরপর আর থাকার সিস্টেম নাই। আমার সংসার চলে গাড়ি চালাইয়া। তাই করোনার ঝুঁকি থাকলেও পেটের দায়ে রাস্তায় নামছি রিকশা লইয়্যা। ’ 

তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে পাশ থেকে আরেক রিকশাচালক মো. হাবিব বাংলানিউজকে জানালেন, ঢাকা শহরের চিরচেনা রাস্তা যেন এখন অচেনা লাগে। এ অবস্থায় আয়-রোজগার একেবারেই কম।  

তিনি বলেন, সকাল ৮ টায় রিকশা লইয়া বের অইছি। দুপুর ১২ টা বাজে। ৪ ঘণ্টায় মাত্র ৮০ টাকার খেপ (ভাড়া) মারছি। করোনার জন্য মানুষ বাইরে বাহির অয় না। জরুরি যেসব দোকানপাট বাজার খোলা রাখার কথা তারও বেশিরভাগ বন্ধ।  

হাবিব জানালেন, ২৫ / ৩০ টাকার তিনটি ট্রিপ দিয়ে ৮০ টাকা পেয়েছন। এই ছুটি ঘোষণার আগে একই সময়ে আয় হতো ৩০০-৩৫০ টাকা।  

২১ বছরের তরুণ আমিন উদ্দিন। বাড়ি নোয়াখালী সদরে। ঢাকায় একটি গণপরিবহনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু করোনার কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বললেন, পাঁচদিন ধরে কাজ নাই। হাতেও টাকা নাই। এখন না খেয়ে থাকার অবস্থা হয়েছে।  

২০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাটে খেয়া পারাপার করেন আবদুর হালিম। তিনি জানান, একদিন কাজ করতে না পারলেই পরিবারের লোকজন কী খাবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যেতে হয়। করোনার কারণে বেশ কয়েক দিন ধরে কাজ করতে পারছেন না। তাই আয়ও নেই। এ অবস্থায় না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়েছে তার।  

‘আগে দিনে সব খরচ বাদ দিয়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হইতো। এখন সেখানে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা অইতাছে। তা দিয়ে বাসা ভাড়া, সংসার খরচ চালানো অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। হুনছি (শুনেছি) সরকার দিনমজুরদের লাইগ্যা সাহায্য দিবো। কিন্তু দিবো কিভাবে? আমরা তো হারাদিন-ই নৌকা চালাই। সাহায্যের জন্য তিন চাইর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াইবো কে?’

তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়াইয়াও পাওয়া যায় না। অহন তো নৌকা চালাইয়া কিছু পাইতাছি। তহন না পাইলে তো দুই দিকই যাইবো। তাই সরকারের সাহায্য যাতে আমরা পাই সেইডা নিশ্চিত করন লাগবো।  

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘করোনার প্রভাবে বুড়িগঙ্গা ও সদরঘাটের কর্মহীন দরিদ্র মাঝি, কুলি, শ্রমিক, দিনমজুরদের পাশে বিআইডব্লিউটিএ’র ঢাকা নদীবন্দর। আত্মপ্রচার নয়, নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ’

পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, বেশ খানিকক্ষণ পর একটি-দু'টি রিকশা বা একজন-দু'জন মানুষ আসা যাওয়া করছেন। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোস্ট। অপ্রয়োজনে মানুষজন যেন রাস্তায় ঘোরাঘুরি না করে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন তারা।

গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও প্রয়োজনীয় পণ্যবাহী ট্রাক, জরুরি ওষুধ সরবরাহকারী পিকআপ ভ্যান ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করতে পারছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা ৫০ হাজার পরিবারকে একমাস নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের কার্যক্রম চলমান। আমাদের ওয়ার্ড পর্যায় থেকে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। আজ রিকশাচালকসহ অন্যান্যদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। কর্মহীন অবস্থায় তাদের যেন খাদ্য সঙ্কটে থাকতে না হয় সেজন্যই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২০ 
জিসিজি/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।