ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

ভালো নেই দ্বীপ ইউনিয়ন ‘গাবুরা’র মানুষ  

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২০
ভালো নেই দ্বীপ ইউনিয়ন ‘গাবুরা’র মানুষ   .

সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। সুন্দরবন সংলগ্ন ৩৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ ইউনিয়নে প্রায় ৪২ হাজার মানুষের বসবাস।  

স্থানীয় অর্থনীতিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করা বাগদা চিংড়ির প্রধান উৎপাদনস্থল যেমন গাবুরা, তেমনি এখানকার বেশির ভাগ মানুষের জীবন জীবিকা সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল।  

গাবুরা ইউনিয়নে আটটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩টি দাখিল ও একটি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা রয়েছে।

এর মধ্যে ১৫টিতে রয়েছে সাইক্লোন শেল্টার। এছাড়া গাবুরার মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য রয়েছে ৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক। রয়েছে ৪টি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও।  

লবণ পানির মধ্যে বসবাসরত হাজার হাজার জনগোষ্ঠির খাবার পানির চাহিদা পূরণে ৯ নম্বর সোরা এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘দৃষ্টিনন্দন’ মিষ্টি পানির আঁধার। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় চাঁদনীমুখা ও জেলেখালী এলাকায় খোলপেটুয়া নদীর চরে গড়ে তোলা হয়েছে কৃত্রিম বনভূমি। এতদিন বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকলেও খুব শিগগিরই বিদ্যুতায়নের আওতায় আসছে এই দ্বীপ ইউনিয়নের মানুষ। এজন্য ইতোমধ্যে বিদ্যুতের লাইন টানা হয়েছে।

.এতসব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার মানুষ ভাল নেই। নানা সমস্যায় জর্জরিত চারপাশে নদী বেষ্টিত গাবুরার ২৭ কিলোমিটার জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ এখনকার মানুষের প্রধান উদ্বেগের কারণ। বার বার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি ম্লান হয়ে যায় সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। সব সময় প্লাবন আতঙ্ক নিয়ে দিনাতিপাত করে এখানকার মানুষ। নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও।

উপজেলার সবচেয়ে জনবহুল ইউনিয়ন হওয়া সত্ত্বেও গাবুরার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। কয়েকশ মিটার আরসিসি রাস্তা ও মুষ্টিমেয় ইটের সোলিংয়ের রাস্তা থাকলেও গাবুরার প্রায় পঁচানব্বই ভাগ সড়কই এখনো কাঁচা। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ দিয়ে চলতে গেলে গা শিউরে ওঠে। যার বেশির ভাগই ভেঙে নদীতে চলে গেছে।

সাগরকূলে বসবাসরত এ জনপদের মানুষকে প্রতিনিয়ত লবণ পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে। উপর্যুপরি বেড়িবাঁধ ভাঙনের কারণে একসময়ের সবুজ শ্যামল জনপদ গাবুরা গাছ-গাছালী শূন্য হয়ে পড়েছে। কৃষি উৎপাদন নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। ফলে এলাকায় কর্মসংস্থানের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বৃক্ষরাজী শূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিয়ত মারাত্মক জ্বালানি সংকটও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

সুপেয় খাওয়ার পানির সংকটে এখানকার মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। পুকুরের পানি খেয়ে কোনো মতে বেঁচে থাকা গাবুরার মানুষকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। সেই সঙ্গে ব্যবহার্য পানিও লবণাক্ত হওয়ায় ছড়াচ্ছে চর্ম রোগ।

.গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের নেই কোনো স্থায়ী ভবন। স্থানীয় একটি স্কুলের দুটি রুমে কোনোমতে চলছে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। এতে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমও যেমন ঠিকভাবে চলছে না, তেমনি ব্যাহত হচ্ছে শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম।

গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনীমুখা গ্রামের বিল্লাল হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, আমরাও বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু আমাদের দেখার কেউ নেই। দুর্যোগ এলেই গাবুরার মানুষের কথা মনে পড়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। পরে আবার ভুলে যায়। এখানকার বেড়িবাঁধগুলো ষাটের দশকে নির্মিত। যা ভাঙতে ভাঙতে আর নেই বললেই চলে। কোথাও পাঁচ ফুট থাকলে কোথাও দেড় দুই ফুট আছে। জানমালের নিরাপত্তার জন্য বেড়িবাঁধ টেকসই প্রযুক্তিতে পুনর্নির্মাণ না করলে এই গাবুরায় কোনো জনবসতি থাকবে না।

একই ইউনিয়নের ডুমুরিয়ার সিদ্দিক গাজী বলেন, গাবুরায় খাওয়ার পানির খুবই সংকট। এখানে টিউবওয়েলে লবণ পানি ওঠে। পুকুরের পানি খেয়ে মানুষ বেঁচে আছে। তাও আনা লাগে স্থান ভেদে চার থেকে সাত কিলোমিটার দূর থেকে। এসব নিয়ে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই।

৯ নম্বর সোরার ইউনুস শেখ বলেন, আমাদের ইউনিয়নই মনে হয় দেশের একমাত্র ইউনিয়ন যেখানে কোনো পিচের রাস্তা নেই। বেড়িবাঁধই আমাদের প্রধান রাস্তা। তাও জরাজীর্ণ। এছাড়া গ্রামের ভেতরের ইটের সোলিংয়ের রাস্তাগুলোয় ইট উঠে গেছে। চলাচল করা যায় না।

গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম বলেন, এখানে সুপেয় খাবার পানির সংকট। বেড়িবাঁধ বলেন, আর রাস্তা বলেন- সবই জরাজীর্ণ। এসব বেড়িবাঁধ ষাটের দশকে নির্মাণ করা হলেও পরে আর পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। জোড়াতালি দিয়ে চলছে।

তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকির শীর্ষে থাকা ইউনিয়ন হলেও এখানকার ৪২ হাজার মানুষের জন্য সাইক্লোন সেল্টার রয়েছে মাত্র ১৫টি। মানুষকে অনেক দূর থেকে খাবার পানি আনতে হয়। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রতিবারই সরকারের সব কর্মকাণ্ড ম্লান হয়ে যায়।

জিএম মাসুদুল আলম আরও বলেন, এখানে ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী কোনো ভবনও নেই। নেই নেই বলতেও খারাপ লাগে- এলাকায় ঘোরেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। যা দেখবেন, তাই লেখেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।