ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ডায়িং কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে ফসল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২০
ডায়িং কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে ফসল

নরসিংদী: শোয়েবুর রহমান পেশায় একজন বর্গাচাষি। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে তাতে চাষ করে চলে তার জীবন-জীবিকা। এবারের শীতেও প্রায় আড়াই কানি জমিতে ধারে টাকা নিয়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি ও সরিষা চাষ করেছিলেন। কিন্তু প্রায় একমাস ধরে ডায়িং কারখানার ইটিপি বিহীন রং কেমিক্যাল ও বর্জ্য মেশানো পানি জমিতে আসায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে তিনি জমিতে কাজ করতে পারছেন না। আর ডায়িং কারখানার দূষিত পানির কারণে জমির ফসলও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডায়িং কারখানার এ বিষাক্ত পানিতে শোয়েবুরের মত অর্ধশতাধিক কৃষকের স্বপ্নও ‘কালছে;’হয়ে গেছে! 

ঘটনাটি নরসিংদীর মাধবদীর নূরালাপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দ নওপাড়া গ্রামের। একই অবস্থা পাশের নওপাড়া ও কান্দাপাড়া এলাকার।

ডায়িং কারখানার ইটিপি বিহীন দূষিত পানি এসব এলাকায় প্রবেশ করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। যার ফলে নষ্ট হচ্ছে কৃষিজ জমি, পুকুরের মাছ, শিশুদের খেলার মাঠ।

স্থানীয়রা জানায়, সারা বাংলাদেশের মধ্যে মাধবদীর কাপড় বিখ্যাত। যার কারণে মাধবদী ও তার আশে পাশে গড়ে উঠেছে শত শত কলকারখানা। এর ধারাবাহিকতায় মাধবদীর খোর্দ্দ নওপাড়া গ্রামেও গড়ে উঠেছে পরিকল্পনাহীন বেশ কিছু কারখানা। খোর্দ্দ নওপাড়া গ্রাম ও এর আশপাশে ছোট-বড় প্রায় ৭টি কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে পাকিজা গ্রুপের পাকিজা অ্যাপারেলস লি. ও পাকিজা ওভেন ফ্যাশন লি., বাংলাদেশ তাঁত বস্ত্র প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, সান ফ্লাওয়ার ডায়িং, ক্রোমা টেক্সটাইল লি., চায়না বাংলা সিরামিক কোম্পানি। এসব কারখানার ইটিপির পানি ধারণ ক্ষমতা কয়েক লক্ষাধিক লিটার যা বাইপাসের মাধ্যমে আগে খালে ফেলা হত। যা পরে নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার পাঁচরুখির ব্রহ্মপুত্র নদীতে গিয়ে মিশতো। দূষিত পানির মাধ্যমে কৃষিজ জমি নষ্ট হচ্ছে এ অভিযোগে এক মাস আগে আড়াইহাজারের বাঘবাড়ি ব্রিজে বাঁধ দিয়ে খালের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয় স্থানীয়রা। যার ফলে ডায়িং কারখানার পানি খাল দিয়ে প্রবাহিত হতে পারছে না। ফলে কারখানার পানিতে খোর্দ্দ নওপাড়া, নওপাড়া ও কান্দাপাড়ার কৃষিজ জমি তলিয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। যার ফলে নষ্ট হচ্ছে কৃষকের ফসল। এলাকাবাসী আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে।

ক্ষেতের ফসলে মিশে গেছে ডায়িং কারখানার দূষিত পানি।  ছবি: বাংলানিউজখোর্দ্দ নওপাড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক তারা মিয়া বলেন, আমি দেড়কানি জমিতে লাউ, কচু, সরিষা চাষ করেছিলাম। কিন্তু কারখানার পানির কারণে আমার ক্ষেতের সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। কারখানায় অভিযোগ করেছিলাম। তারা দুই দিনের মধ্যে পানি সরানোর ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাদের সেই আশ্বাস এখনও বাস্তবায়ন হয় নাই।

আরেক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক উমেদ মিয়া বলেন, আমি জমিতে পালং ও লালশাক চাষ করেছিলাম। কিন্তু কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত পানির কারণে আমার সব শাক নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে আমার প্রায় ৩০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।

কারখানার পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আকমান উদ্দিন বলেন, আমার ফার্মে প্রায় ১ হাজার মুরগি ছিল। কেমিক্যাল পানির প্রভাবে মুরগি মারা যেতে যেতে এখন ২০০ আছে। দু’য়েকদিন আগেও ১০ মুরগি মারা গেছে। আর আমার পুকুরের সব মাছ কেমিক্যালের প্রভাবে মারা গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছি।

খোর্দ্দ নওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাব্বির হোসেন বলেন, ডায়িং কারখানার পানির কারণে আমাদের এলাকার কৃষিজ ও পতিত সব জমি তলিয়ে গেছে। শিশুরা যে মাঠে খেলাধুলা করতো তা এখন পানির নিচে। আর কেমিক্যাল মিশ্রিত পানিতে চলাচলের কারণে সবাই বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সামনে বর্ষাকাল, পানির অবস্থা এভাবে থাকলে মশার প্রাদুর্ভাব বাড়বে। তাই দ্রæত পানি সরিয়ে নেওয়ার দাবি করছি। ক্ষেতের ফসলে মিশে গেছে ডায়িং কারখানার দূষিত পানি।  ছবি: বাংলানিউজ

পাকিজা গ্রুপের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, আমাদের ডায়িং কারখানায় বায়োলিজিক্যাল ইটিপি রয়েছে। যার ধারণ ক্ষমতা ৩ প্রায় লাখ লিটার। আমাদের ডায়িংয়ের পানি ইটিপি হয়েই আগে খালের মাধ্যমে নদীতে প্রবাহিত হতো। কিন্তু খালে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে তা আমাদের নিজস্ব ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে পৌরসভার ড্রেনে চলে যাচ্ছে। আমাদের ডায়িংয়ের পানি আশেপাশের এলাকার কৃষিজ জমিতে প্রবাহিত হচ্ছে না। অন্য কোন কারখানার পানির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। আর আমরা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি তারা আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে বসে দ্রæত খালের বাঁধের সমস্যা সমাধান করে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।

বাংলাদেশ তাঁত বস্ত্র প্রক্রিয়াকরণ কারখানার এজিএম হুমায়ূন শেখ বলেন, আমাদের ডায়িংয়ের পানি কারখানার পাশের একটি নালায় জমা হয়। ওইখান থেকে এখন পাম্পের মাধ্যমে পানি ড্রেনে ফেলা হচ্ছে। পানি কোনো এলাকায় প্রবেশ করছে না।

নওপাড়া ও কান্দাপাড়া এলাকার ফকুল মেম্বার বলেন, কারখানার পানিতে আমার এলাকার প্রায় ৫০ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কারখানা নামমাত্র পানি পাম্পের মাধ্যমে ড্রেনে ফেলছে বাকি পানি এখনও এলাকায় প্রবেশ করছে। আমাদের দাবি কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দ্রুত পানি সরিয়ে ফেলতে হবে। না হলে আরো কৃষিজ জমি পানিতে প্লাবিত হয়ে ফসল নষ্ট হবে।

ইটিপি বিহীন ডায়িং কারখানার।  ছবি: বাংলানিউজনূরালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম বলেন, খালে বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় পানি আশেপাশের এলাকায় প্রবেশ করছে। আমাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কারখানা পানি ফেলা বন্ধ করলেও বাকিরা এখনও পানি ফেলছে। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত বাঁধ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণের জন্য তালিকা করা হচ্ছে।

নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক মো. হান্নান বলেন, নরসিংদীর সব ডায়িং কারখানাতেই ইটিপি প্লান্ট রয়েছে। আমরা প্রতি তিন মাস পর পর তারা ইটিপি ব্যবহার করছে কিনা তা দেখে লাইসেন্স নবায়ন করি। আর ড্রায়িংয়ের বর্জ্য ইটিপি হওয়ার পর ও পানি থেকে কেমিক্যালের রঙের বর্ণ যায় না। যার ফলে পানি দেখতে রঙিন দেখা যায়। খালের বাঁধের বিষয়টি প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর আমরা খোঁজ নিয়ে দেখবো ইটিপি পানির কারণে কৃষিজ জমি নষ্ট হচ্ছে কিনা। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২০
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।