ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘গাছ দম্পতি’র ৫০০ বছরের পথচলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০
‘গাছ দম্পতি’র ৫০০ বছরের পথচলা

ধামরাই (ঢাকা): ইট-পাথরে গড়া রাজধানী ঢাকা। এ জেলার কাছে মফস্বল এলাকা বলতে রয়েছে ধামরাই। ৩০৬.৩৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলাটি নানা ঐতিহ্য আর ইতিহাস বুকে ধারণ করে নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

প্রাচীন মুঘল সম্রাটরা বিশ্ব বিখ্যাত তাঁতের মসলিন ব্যবহার করতেন। এই মসলিন কাপড় ধামরাইয়ে তৈরি হওয়ায় অঞ্চলটি ছিল বিখ্যাত।

এছাড়াও মাটির তৈরি শিল্পকর্মের জন্যেও বিখ্যাত এ অঞ্চলটি। ধামরাইয়ের ঐতিহাসিক যশোধামাধব রথ আর জগন্নাথের মামা বাড়ি যাওয়ার দিনে ‘রথযাত্রা’র জন্য বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে এ উপজেলার।

এ অঞ্চলের ঐতিহ্য-ইতিহাস শেষ হওয়ার নয়। এমনই ঐতিহ্যবাহী দুটি গাছ আজও ইতিহাস হয়ে দৃশ্যমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের সাইট্টা গ্রামে।

জানা যায়, ৫০০ বছর আগে দেবীদাস বংশের পূর্ব পুরুষরা ঢাকঢোল, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বিবাহের মাধ্যমে তাদের ভিটের ওপর রোপন করেছিলেন বট ও পাকুড় নামে এই দুই গাছটি। গাছ দুইটির বিয়ে উপলক্ষে তখন বহু লোকের খাবারের আপ্যায়নের আয়োজনও করেছিলেন দাস বংশের লোকেরা। সেখান থেকেই শুরু হয়ে এখনো স্থানীয়রা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গাছ দুটিকে স্বামী-স্ত্রী বলেই অভিহিত করেন।

বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনাও রয়েছে বট-পাকুড় গাছ নিয়ে। এ কারণে ভয়ে এলাকার কেউ ওই গাছের ডাল-পালা বা গোড়া কাটেনি। এরফলে গাছ দুটি অসংখ্য শিকড় ছেড়ে পাঁচ বিঘা জমি দখল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিজের মতো করে।

এ অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করেন গাছ দুটি তাদের দেবতা। মুসলমান সম্প্রদায়ও সম্মান করেন এই গাছ দুটিকে। হিন্দু সম্প্রদায় বটগাছের নিচে কালীমন্দির নির্মাণ করে সেখানে কালী, সরস্বতী, বুড়ির পূজা এবং দশমী ও বাসন্তী মেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে। নানা অসুখ-বিসুখে মানত করেন সকল ধর্মের লোকজন, আবার এ থেকে সুস্থতা পেয়েছেন মনে করে এরপ্রতি আস্থা রাখার ঘটনাও প্রচুর।

সরজমিনে গাছ দুটি দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে আরও নানা দৃশ্য। সাইট্টা গ্রামে ঢুকতেই পিচ ঢালা পাকা রাস্তার দুই পাশে চিরচেনা গ্রামের সব উপকরণ দেখতে পাবেন এখানে। রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, আখ ক্ষেত আর সঙ্গে প্রচুর লেবু ও কলা বাগান। মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতো একটি গ্রাম। গাছ দুটি মাটির মেঠ পথের উপর দিয়ে এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে গেছে। গাছ দুটির কাছে যেতেই চোখে পড়লো তাদের সু-বিশাল দেহের কাঠামো। দুটো গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় শতাংশ জমির ওপর। দেখলেই মনে হবে কয়েকশ’ বছর ধরে তারা এভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

গাছ দম্পতি। স্থানীয় বাসিন্দা পরিতোষ ‍দাস বাংলানিউজকে বলেন, এই গাছগুলো কেউ কাটতে পারে না। অনেক ইতিহাস আছে এই গাছ দুইটি কাটা নিয়ে। যখনই যে গাছগুলোকে কেউ কাটতে ‍আসে বা গাছের কোনো ‍ক্ষতি করার চেষ্টা করে সেই ব্যক্তির কোনো না কোনো সমস্যা হয়। এখানে একটা মন্দির আছে সেই মন্দিরে সব সময় পূজা করা হয়।

সাইট্টা গ্রামের আরেক বাসিন্দা বৃদ্ধ নয়ন লাল দাস বাংলানিউজকে বলেন, আমার জন্মের পর থেকেই গাছ দুটোকে এভাবেই দেখছি। আমার বাবা-দাদার কাছে শুনেছি এখানে প্রায় ৫০০ বছর আগে কোনো এক সম্রাট একটি বট গাছ ও একটি পাকুড় গাছ লাগিয়ে ছিলেন। এর কয়েক বছর পর গাছ দুটির গোড়া (নিচের অংশ) এক সঙ্গে লাগানো দেখে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দেয়। সেই সময় থেকে এখানে পূজা করা হয়।

যাদবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজু বাংলানিউজকে জানান, এই গাছ দুটি অনেক পুরনো। জন্মের পর থেকেই গাছগুলোকে এমনি দেখছি। স্থানীয়দের প্রায় কয়েক বিঘা জমি নিয়ে এই গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। সু-বিশাল গাছগুলোকে স্থানীয়রা অনেক সম্মান করেন। কেউ কেটে ফেলতে চায় না। গাছ কাটার জন্য গেলে তার কোনো না কোনা ক্ষতি হয়।

তিনি আরও বলেন, এই গাছ দুটির পাশেই একটি কালী মন্দির আছে। সেই মন্দিরটিও অনেক পুরোনো। কোনো একদিন এক যুবক এই মন্দিটি ভাঙতে চেয়েছিল। এর কয়েকদিন পর থেকেই যুবক এখন প্রতিবন্ধী কথা বলতে পারে না হাঁটতে পারে না। তারপর থেকে এই গাছ বা মন্দিরের কেউ ক্ষতি চায় না।

তিনি বলেন, এই স্থানটি নির্জন হলেও এই এলাকার মানুষ অনেক ভালো। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষও এখানে ভালো নিরাপত্তা পায়। গাছগুলো দেখতে আসা দর্শণার্থীরাও নিরাপদে থাকেন।   

৫০০ বছর পুরাতন এই বট ও পাকুড় গাছের ছায়া তলেই রয়েছে পানির ব্যবস্থা। সাঁতার কেটে, গা ডুবিয়ে গোসলের জন্য রয়েছে অনেকগুলো পুকুর। বট-পাকুড়ের সুশীতল ছায়ায় নিরিবিলি পরিবেশে প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়ায় মন ভালো করতে চলে আসতে পারেন এই গ্রামে।

ঐতিহ্যবাহী বট ও পাকুড় গাছ দেখতে আসবেন যেভাবে:- গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে ডি-লিংক, বিআরটিসি, শুভযাত্রা বাসে করে ৫০ কিলোমিটার পরের ধামরাই ঢুলিভিটা নেমে অটোরিকশা করে যাদবপুরে আসতে হবে। যাবদপুর থেকে নেমে ‍পাঁয়ে হেঁটে ২০ মিনিট বা রিকশায় ১০ মিনিটে চলে আসতে পারেন ঐতিহ্যবাহী বট ও পাকুড় গাছ দেখতে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad