ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দখল-দূষণে ধুঁকছে করতোয়া 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২০
দখল-দূষণে ধুঁকছে করতোয়া 

বগুড়া: বগুড়ায় দখল-দূষণে ও অবহেলায় ধুঁকছে জীবন্ত করতোয়া। হাঁটুপানির উপর ভাসছে ময়লা-আবর্জনা। আবর্জনা ফেলতে ফেলতে নদী পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। নদীতে ময়লা ও আবর্জনাসহ যেকোনো ধরনের বর্জ্য না ফেলার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও কেউ তা মানছে না। বরং এক সময়ের খরস্রোতা নদীটিকে এখন ‘ভাগাড়’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রোববার (০২ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শহরের ফতেহ আলী বাজারের পূর্ব দিকে ব্রিজ থেকে উত্তর ও দক্ষিণের অংশের নদী তীরবর্তী এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। বছরজুড়ে সেখানে রাত-দিন বর্জ্য ফেলা হলেও যেন দেখার কেউ নেই।

বর্ষা মৌসুমে বর্জ্যগুলো স্রোতে ভেসে গেলেও এখন শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় ফতেহ আলী ব্রিজের দক্ষিণ পশ্চিমপ্রান্তে যেন ‘বর্জ্যের পাহাড়ে’ পরিণত হয়েছে।

নদীতে ফেলা হচ্ছে বিয়েসহ বিভিন্ন ভোজের অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত ওয়ান টাইম প্লেট, গ্লাস, ফল সংরক্ষণের প্লাস্টিকের প্যাকেট, পলিথিন ব্যাগ, শহরে অবস্থিত ফতেহ আলী বাজারে জবাই করা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও কবুতরের নাড়িভুঁড়ি, পালক এবং বিষ্ঠাসহ মৃত পশু-পাখিও।

ফতেহ আলী ব্রিজ থেকে প্রায় ছয়-সাত শত গজ দক্ষিণে এ নোংরা পানিতেই প্রতিদিন কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করেন এক শ্রেণির মানুষ। জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি ধোপার কাজ করেন তারা।
 
এসব মানুষগুলো বেঁচে থাকতে বেছে নিতে হয়েছে ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন পদ্ধতি। থাকার জায়গায় পানির ব্যবস্থা না থাকায় সাংসারিক ও বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য নির্ভর করতে হয় এ পানির ওপর। উপায়ান্ত না পেয়ে ক্ষতির বিষয়টি জেনে-বুঝেই এ কাজটি করছেন তারা।
 
এককালের খরস্রোতা করতোয়া নদীর বর্তমান দৃশ্য এমনই। নদীটি বগুড়া শহরের পূর্বদিক দিয়ে বহমান। দখলবাজদের দৌরাত্ম্যে কালের আবর্তে নিজস্ব গতিপথ হারিয়ে ফেলেছে করতোয়া। সরু হয়ে আসছে তার বিশাল বুক। ফাঁকা রয়েছে শুধুই পেটটুকু। তাও দখলে-দূষণে ভরে উঠছে। এক সময়ের জীবন্ত করতোয়া মরণের কবলে ধুঁকছে।

কলকারখানা ও পাশ দিয়ে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনার বিষাক্ত বর্জ্যযুক্ত পানি এ নদীতে ফেলা হচ্ছে বিরামহীনভাবে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। দখলদারদের কাছে সংশ্লিষ্ট সবাই যেন জিম্মি।

পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বলছেন, শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব বগুড়া পৌরসভা কর্তৃপক্ষের। এজন্য করতোয়া নদীতে বর্জ্য না ফেলানোর বিষয়টি তদারকির জন্য আদালত পৌর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রতিষ্ঠানটি এ ব্যাপারে রীতিমতো উদাসীন। আর নদীর মালিক জেলা প্রশাসন শুধু চিঠি দিয়েই তাদের ‘অফিসিয়াল দায়িত্ব’ পালন করে যাচ্ছে। ফলে করতোয়া নদীতে বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে দূষণের কবল থেকে করতোয়াকে রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আবারও আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছে।

কারণ, করতোয়ার হারানো যৌবন ফিরিয়ে দিতে এখনও কেউ এগিয়ে আসেননি। আগামীতে কেউ আসবেন কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ-সংশয় রয়েছে।

ফতেহ আলী ব্রিজের দক্ষিণ পশ্চিমপ্রান্ত যেন বর্জ্যের পাহাড়।  ছবি: বাংলানিউজতবে ‘বেলা’ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন এ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালের জুনে বগুড়া ও গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট ২১ জনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট করে। পরে শুনানি শেষে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে হাইকোর্ট আদেশ দেন।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে একই বছরের জুলাইয়ে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ছয়জন ব্যক্তির গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয়। এরপর সেই উচ্ছেদ অভিযান আর এগোয়নি।
 
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বাংলানিউজকে জানান, আদালতের ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে করতোয়া নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদে বিভিন্ন সময় স্থানীয় জেলা প্রশাসনের তৎপরতা দেখা গেলেও দূষণ রোধে পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।  

তিনি বলেন, পৌর কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতায় দোকানিসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দৈনন্দিন নানা ধরনের বর্জ্য সরাসরি করতোয়া নদীতে ফেলতে শুরু করেছে। বিষয়গুলো জেলা নদী কমিটির সভায় একাধিকবার উত্থাপন করা হলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।


এদিকে আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে ফতেহ আলী বাজার কাঁচামাল ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আবু কালাম আকন্দ বাংলানিউজকে জানান, আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তাদের জানা নেই।  

তিনি বলেন, এখন থেকে পৌরসভার মাধ্যমে আমরা বর্জ্য অপসারণ করবো।

বগুড়া জেলা প্রশাসন এ পর্যন্ত প্রায় ২৮ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরমধ্যে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) ও ডায়াবেটিক হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

শুধু পৌর এলাকায় অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে গাইবান্ধা জেলায় কতোজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করতোয়া নদী অবৈধভাবে দখল করে স্থায়ী ও অস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করেছে এর কোনো হিসেবে নেই।

করতোয়া নদীর দখল ও দূষণ রোধে উচ্চ আদালতে রিটকারি পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল বাংলানিউজকে জানান, করতোয়া নদীর দূষণ রোধে স্থানীয় প্রশাসন সবধরনের উদ্যোগ নেবেন বলে তারা আশাবাদী। তবে যদি তাদের ঘাটতি দেখা যায় তাহলে হয়তো আবারও আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।

নদীটি অবৈধ দখলমুক্ত ও স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে হবে। না হলে এ সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব নয় বলেও যোগ করেন তিনি।  

এছাড়া বিষয়টি নিয়ে তারা প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়সহ নানা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২০
কেইউএ/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।