ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নৌ দুর্ঘটনায় লঞ্চ মাস্টারদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২০
নৌ দুর্ঘটনায় লঞ্চ মাস্টারদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন চলতি শীত মৌসুমে নদীপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

বরিশাল: চলতি শীত মৌসুমে নদীপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে। সেসব দুর্ঘটনার পেছনে কুয়াশাকে দায়ী করছেন লঞ্চ চালনার দায়িত্বে থাকা মাস্টার-ড্রাইভাররা। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন খননের অভাবে নৌযান চলাচলের পথ বা চ্যানেল সরু হয়ে যাওয়া এবং অবৈধ নৌযান দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে বলেও দাবি তাদের।

এদিকে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, পরিষ্কার নির্দেশনা থাকলেও, তা উপেক্ষা করে ঘন কুয়াশার মধ্যে লঞ্চ চালনার কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে মাস্টার-ড্রাইভারদের দক্ষতা নিয়েও।

এ অবস্থায় লঞ্চ চালনার সঙ্গে জড়িতদের প্রাপ্ত সনদের ওপর অভিজ্ঞতা যাচাই এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি তুলেছেন যাত্রীরা।

শুধু চলতি শীত মৌসুমে ৬ ডিসেম্বর দিনগত রাতে মেঘনা নদীর মোহনায় বোগদাদিয়া-১৩ ও মানিক-৪ লঞ্চের সংঘর্ষে এক যাত্রী নিহত হন। এরপর ১৪ ডিসেম্বর দিনগত রাতে কীর্তনখোলা নদীতে ঢাকাগামী শাহরুখ-২ লঞ্চের সঙ্গে সংঘর্ষে একটি মালবাহী কার্গো ডুবে যায়। এতে কেউ হতাহত না হলেও ১২শ’ টন ক্লিংকারসহ তলিয়ে যায় কার্গোটি। এরপর গত ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সন্ধ্যা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চের ধাক্কায় একটি মালবাহী নৌযান ডুবে যায়। একে কেউ হতাহত না হলেও ১৪শ’ বস্তা মুরগির খাবার জাহাজের সঙ্গে নদীতে তলিয়ে যায়। ১২ জানুয়ারি দিনগত রাতে বরিশাল থেকে ছেড়ে যাওয়া কীর্তনখোলা-১০ এবং ঢাকা থেকে আসা ফারফান-৯ লঞ্চের সংঘর্ষে মা ও ছেলে নিহত হন এবং আরও ৮ যাত্রী আহত হন। এরপর ১৬ জানুয়ারি দিনগত রাতে বরিশালের হিজলা থেকে ঢাকাগামী ও ঢাকা থেকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়াগামী দুই লঞ্চের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চাঁদপুরের আলুবাজার ও ঈশানবালার মধ্যবর্তী মেঘনা নদীতে এ সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচ যাত্রী আহত হন।

মর্মান্তিক এসব দুর্ঘটনার পরে প্রশ্ন ওঠে চালক বা মাস্টারদের দক্ষতা নিয়ে। কীর্তনখোলা-১০ এবং ফারফান-৯ লঞ্চের সংঘর্ষের ঘটনার পর সেখানে একই সময়ে থাকা অন্য লঞ্চের মাস্টাররা বলছেন, একই সারিতে থাকা কমপক্ষে তিনটি লঞ্চ তাদের রাডারে ফারহান-৯ নামের লঞ্চটিকে তাদের দিকে অগ্রসর হতে দেখেন। তবে কোন লঞ্চের দিকে সেটি অগ্রসর হচ্ছে তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই ভিএইচএফ বা খুব উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি সম্পন্ন রেডিওর সাহায্য নেন দুর্ঘটনা কবলিত কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চটি।

এর সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে ও পেছনে থাকা লঞ্চগুলোও ভিএইচএফের মাধ্যমে ফারহান-৯ লঞ্চকে সতর্ক করার কাজ করছিল। কিন্তু এসব লঞ্চের মাস্টাররা জানান, তাতে কোনো সাড়া-শব্দই করেননি ফারহান-৯ লঞ্চের চালক। আবার কীর্তনখোলা ও সন্ধ্যা নদীতে যে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে রাতে যাত্রীবাহী নৌ-রুটে মালবাহী জাহাজ চলাচলের নিয়ম ছিল না; কিন্তু ঘটেছে এর উল্টো।

যদিও যাত্রীরা বলছেন, যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোতে রাডারসহ আধুনিক সরঞ্জাম থাকার পরেও কীভাবে বর্তমান সময়ে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে তা বোধগম্য নয়। তবে রাডার থাকার পরেও এক লঞ্চের সঙ্গে আরেক লঞ্চের সংঘর্ষ মানেই প্রশ্ন ওঠে চালকদের দক্ষতা নিয়ে। ঢাকা-বরিশাল রুটের নিয়মিত যাত্রীরা বললেন, শুধু সনদ দেখে নয়, সনদের সঙ্গে বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা যাচাই করা প্রয়োজন।

মাস্টারদের মতে, আধুনিক ও সনাতন দুই পদ্ধতি ব্যবহার করেই নৌযানগুলো চলছে নদীতে। যেমন অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলরত বাল্কহেডসহ ছোট লঞ্চগুলোতে রাডার, ভিএইচএফ, ইকোসাউন্ডারসহ আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতির বালাই নেই। সেগুলো সনাতন পদ্বতিতেই চলাচল করছে।

এতে করে যার রাডার আছে, সে দেখছে প্রযুক্তিতে; আর যার নেই সে সরাসরি চোখ দিয়ে দেখছে। আবার যার ভিএইচএফ আছে সে পার্শ্ববর্তী নৌযানের চালকের সঙ্গে কথা বলতে পারছে, আবার যার নেই সে খালি গলায় নয়তো মাইকের মাধ্যমে উচ্চ সরে কথা বলার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে অনেক সময় ইঞ্জিনের শব্দে কথাগুলো শুনতে পায় না অপর নৌযানের চালক।

সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির লঞ্চের মাস্টার মজিবর রহমান জানান, আধুনিক সরঞ্জাম শুধু সংযোজন হচ্ছে, তবে অভ্যন্তরীণ রুটের বেশিরভাগ মাস্টারই অপ্রশিক্ষিত এসব বিষয়ে। রাডার, ইকোসাউন্ডার, ভিএইচএফ, জিপিআরএসসহ যেসব প্রযুক্তি টেকনিশিয়ানরা লাগিয়ে দিয়ে যান, তা শুধু অন-অফ করাই দেখিয়ে দিয়ে যান তারা। কিন্তু সেটির আর কী ফাংশন রয়েছে তা কেউ জানতে চায় না। ফলে এটি শেখারও আগ্রহ কারো থাকে না। যেটুকুও বা জানছেন মাস্টাররা, তাও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নয়।

এদিকে ধারণা না থাকলেও অর্থের বিনিময়ে যারা সনদ নিয়েছেন, তাদের কাজে নেমে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে। ঢাকা-বরিশালে রুটের একজন মাস্টারের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির মাস্টার সনদ পেতে দুই থেকে চার লাখ টাকা খরচ করলেই হয়। আর এভাবে প্রশিক্ষণ না নিয়েই অনেকেই সার্ভিসে থেকে হয়ে গেছেন মাস্টার।

যদিও বিআইডিব্লউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-পরিচালক আজমল হুদা মিঠু সরকার বলেন, আমরা চালকদের ও নৌযানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে কি-না সেটি দেখে থাকি। কীভাবে তাদের সনদ আসলো সেটি আমাদের বিষয় নয়। তবে কিছু নীতিমালা রয়েছে যা চালক বা মাস্টারদের শতভাগ মানা প্রয়োজন, যা তারা মানেন না। যেমন দুর্যোগের সময় নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তেমনি ঘন কুয়াশাতেও লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ঘন কুয়াশা দেখা দিলে মাস্টাররা লঞ্চটি নিরাপদ স্থানে নোঙর করে রাখবেন এবং কুয়াশা কেটে গেলে আবার চালনা করবেন, কিন্তু সেটি তারা করছেন না।

এ বিষয়ে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের ইঞ্জিনিয়ার ও শিপ সার্ভেয়ার আবু হেলাল সিদ্দীকি বলেন, আর্থিক লেনদেনের কোনো ধরনের বিষয় আমাদের জানা নেই। আর বরিশাল থেকে সনদ দেওয়ার কোনো বিষয়ও নেই। প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে চালকদের প্রাপ্ত প্রতিটি সনদের কাগজ প্রতিনিয়ত আমরা চেক করছি।

ঢাকা-বরিশাল রুটে যাত্রীবাহী কোনো লঞ্চের মাস্টার সনদবিহীন নেই জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত আমরা নদীতে অভিযান চালাচ্ছি।   যেখানে অবৈধ নৌযান ও চালকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। যেখানে জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে আমাদের। সর্বোশেষ ৯ জানুয়ারিও অভিযান চালানো হয়েছে। আর গেলো বছরের হিসাব করলে এসব অভিযান থেকে অর্ধ কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত ইনল্যান্ড (দেশের অভ্যন্তরে) নৌযানগুলোর জন্য নীতিমালা আধুনিক হচ্ছে, আইনও পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা যার সঙ্গে প্রতি মুহুর্তে সবাইকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।

সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন মাস্টারের নিজের বুদ্ধিমত্তা ও সচেতনতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটের নৌযানগুলোতে আগের থেকে এখন প্রযুক্তির বেশি সংযোজন ঘটছে। আর বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে আমরাও মাস্টারসহ সংশ্লিষ্টদের জন্য এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করছি। কুয়াশায় দুর্ঘটনা রোধে মাস্টারদের প্রশিক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে মালিক সমিতিকে একটি চিঠি দিয়েছি এবং এর আয়োজন আমরাই করছি।

তার মতে, সংস্থার জোড়ালো সার্বিক তত্ত্বাবধানের কারণে নৌ-পথ ও নৌযানের সার্বিক উন্নয়ন যেমন ঘটছে, তেমনি দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং ধরন অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২০
এমএস/এফএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।